পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি যে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তা এখন আর আড়াল করার সুযোগ নেই। একদিকে জনসংযোগ বাড়াতে নানা ধরনের কর্মসূচি, সমাবেশ, সাংস্কৃতিক উৎসব কিংবা ধর্মীয় আবহ তৈরি করা হলেও মূল রাজনৈতিক লড়াইয়ে দলটি একেবারেই হালে পানি পাচ্ছে না।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য বিজেপির ভেতরে যাদের নিয়ে আলোচনা সবচেয়ে বেশি, তাঁরা আসলে ‘ফ্রি স্টাইল ব্রিগেড’, অর্থাৎ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে রাজনীতির ময়দানে সক্রিয়, কিন্তু এতসব উদ্যোগের পরও ভোটারদের আস্থা কুড়াতে পারছে না বিজেপি, বরং নানা বিভাজন, দ্বন্দ্ব আর কৌশলগত অসামঞ্জস্যে জর্জরিত দলটি। শুভেন্দু অধিকারী, সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ, শান্তনু ঠাকুর, জ্যোতির্ময় মাহাতো কিংবা রাজু বিস্তার মতো নেতারা কেউ কেউ তৃণমূল থেকে আসা, কেউ আবার তৃণমূলের জনসংযোগের ধরন নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন, কেউ আবার পুরোপুরি আলাদা ভঙ্গিতে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে চাইছেন, কিন্তু রাজ্যের মূল রাজনীতির স্রোতে তাঁরা একসঙ্গে কোনো ছাপ ফেলতে পারছেন না।
ভোটাররা তাঁদের এই আলাদা আলাদা কর্মসূচিকে প্রায়শই বিভক্ত রাজনীতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখছেন। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, শুভেন্দু অধিকারী দলের হাইকমান্ড হয়েও বিধানসভায় ও বাইরে নিজের মতো আন্দোলন করে চলেছেন। সুকান্ত মজুমদার জনসংযোগে উৎসবমুখী কৌশল নিয়েছেন। দিলীপ ঘোষের দলীয় পদ না থাকলেও নিজস্ব ছন্দে কর্মসূচি চালাচ্ছেন। শান্তনু ঠাকুর মতুয়া সমাজের মধ্যে আলাদা সমাবেশ করছেন। জ্যোতির্ময় মাহাতো আলাদা মঞ্চ তৈরি করছেন আর রাজু বিস্তা পাহাড়ের রাজনীতিতে একক আধিপত্য বজায় রাখছেন। ফলে একই দলে থেকেও তাঁরা পরস্পরের সঙ্গে একযোগে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন না।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি বিজেপির জন্য আরও কঠিন, কারণ, রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এখনো গ্রামীণ পর্যায়ে শক্তিশালী ভিত্তি ধরে রেখেছে এবং বিজেপির বিভক্ত কৌশল আসলে তৃণমূলকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে। রামনবমী কিংবা হনুমান জয়ন্তী ঘিরে সমাবেশ থেকে শুরু করে আতশবাজির প্রদর্শনী বা নদীর ঘাটে প্রদীপ জ্বালানো—সবকিছু বিজেপি নেতাদের কর্মসূচির অংশ হলেও তা রাজ্যের মানুষের চোখে বিকল্প শাসনের বার্তা তৈরি করতে পারছে না, বরং রাজ্যের মানুষ মনে করছেন, এগুলো কেবল জনসংযোগ বাড়ানোর আয়োজন, যা ভোটবাক্সে প্রতিফলিত হচ্ছে না।
সম্প্রতি খড়্গপুরে দিলীপ ঘোষের আয়োজিত শহীদ স্মরণ সমাবেশ কিংবা পুরুলিয়ায় জ্যোতির্ময়ের আয়োজন ঘিরে কিছুটা জনসমাগম হলেও তার প্রভাব রাজ্যের বৃহত্তর রাজনৈতিক অঙ্গনে পড়েনি, বরং দলের ভেতরে কে কতটা প্রভাবশালী, তা নিয়ে বেশি জল্পনা তৈরি হচ্ছে। শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বে মতুয়া সমাজে সিএএ নিয়ে যে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, তা আজও পূর্ণ বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি, যার ফলে সমর্থকদের ভেতরেও হতাশা বাড়ছে। রাজু বিস্তা পাহাড়ে এখনো শক্তিশালী হলেও সমতলে তাঁর কোনো প্রভাব নেই, ফলে দলের ভেতরে ছড়ানো নেতৃত্বই আজ বিজেপিকে সংকটে ফেলেছে।
অনেকে বলছেন, এই ‘ফ্রি-স্টাইল রাজনীতি’ আসলে জনসংযোগে কিছুটা লাভ দিলেও নির্বাচনী রাজনীতিতে জটিলতা বাড়াচ্ছে। কারণ, ভোটারদের কাছে দলীয় ঐক্য ও শক্তি প্রদর্শন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অথচ বিজেপি সেই ঐক্য প্রদর্শন করতে পারছে না। দলটি কয়েক বছর আগে লোকসভায় ভালো ফল করলেও বিধানসভায় সে জোয়ার থেমে গেছে। এর পর থেকে বিজেপি সংগঠনগতভাবে বারবার পিছিয়ে পড়ছে, রাজ্য সভাপতির পদে বারবার পরিবর্তন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীলতা এ দুর্বলতাকে আরও প্রকট করছে।
বর্তমান বাস্তবতায় রাজ্যে বিজেপি জনসংযোগের নানা অভিনব উদ্যোগ নিলেও মূল রাজনৈতিক সমীকরণে কোনো লাভ তুলতে পারছে না, বরং হালে পানি না পাওয়ার এ সংকট আরও গভীর হচ্ছে। বিশেষ করে, রাজ্যের সাধারণ মানুষ যখন বিকল্প শাসনের প্রশ্নে বিজেপির ভেতরের বিভাজন ও কৌশলগত অসামঞ্জস্য প্রত্যক্ষ করছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে বিজেপি হয়তো রাজ্যে কয়েকটি আসনে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় ভোট পেতে পারে, কিন্তু বৃহত্তর রাজনৈতিক লড়াইয়ে তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ করার অবস্থায় তারা নেই, বরং প্রতিদিনই তাদের দুর্বলতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।