২০২৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কংগ্রেসের কাঠামোগত দুর্বলতাকে আবারও স্পষ্ট করে দিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এটি আগামী বছর চারটি রাজ্য ও একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিধানসভা নির্বাচনে আঞ্চলিক মিত্রদের সঙ্গে কংগ্রেসের দলীয় হাইকমান্ডের প্রভাবকে সীমিত করবে।
দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তৎপরতা—দেশজুড়ে শোরগোল করে সফর, প্রচার কোনোটিই আসন বাড়াতে কাজে লাগছে না। এর কারণ রাজ্য পর্যায়ে সংগঠন দুর্বল এবং প্রার্থী বাছাই ও প্রচারে আঞ্চলিক নেতাদের আধিপত্য ক্রমশ বেড়ে চলেছে।
আর বারবার এমন ভরাডুবি রাজ্য নেতা ও জোটসঙ্গীদের কাছে স্পষ্ট করেছে যে, কংগ্রেসের হাইকমান্ড ভোটে জয়ের কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। ফলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ‘নৈতিক আধিপত্য’ বা দর-কষাকষির ক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। বিপরীতে আঞ্চলিক নেতাদের ক্ষমতা আরও বাড়ছে, যেখানে তাঁদের নিজস্ব রাজ্য রাজনীতি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই চলছে।
বিহার সেই বাস্তবতাকে আরও পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল ও বাম—দুই দিক থেকেই চাপ
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের মতে, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসকে এখন রাজ্য ইউনিটের সিদ্ধান্তেই চলতে হবে। কিছুদিন আগে খবর এসেছিল, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে খুশি করতে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য কংগ্রেসে পরিবর্তন এনেছে। অনেকে বলছেন, মমতার বিরুদ্ধে তির্যক বক্তব্যের কারণে অধীর রঞ্জন চৌধুরীকে সরিয়ে ‘নরম স্বভাবের’ শুভংকর সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শুভংকর সরকারকে অনেকে নমনীয় ও সমন্বয়কারী মুখ হিসেবে দেখছেন। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী ইতিমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন—রাজ্য রাজনীতিতে তিনি কোনো জাতীয় মিত্রকে গুরুত্ব দিতে চান না। দলের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সোনিয়া গান্ধীর সম্পর্ক কিছুটা সৌহার্দ্যপূর্ণ হলেও রাহুল গান্ধীর প্রতি তাঁর মনোভাব অনেকটাই শীতল।
অন্যদিকে বামফ্রন্ট কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের জোট। তবে তারাও এখন একা লড়াইয়ের কথা ভাবছে। দীর্ঘদিন কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ফল না পাওয়ায় বাম শিবিরের ভেতরে অসন্তোষ বেড়েছে। কংগ্রেসের অভিজ্ঞ নেতারাও বলছেন—আগামী দিনগুলো আরও কঠিন হবে।
আসামে জোটসঙ্গীদের দাবি আরও বেশি
আসামে বিহারের ফলাফল কংগ্রেসের অবস্থান আরও দুর্বল করে দিয়েছে। এখানে বদরুদ্দিন আজমলের নেতৃত্বাধীন এআইইউডিএফ ও কংগ্রেস মাঝে মাঝে নির্বাচনী সমঝোতায় এলেও তা সব সময় ফলপ্রসূ হয়নি। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবার রাজ্যের মিত্র দলগুলো আসন বণ্টন থেকে প্রচার কৌশল—সবক্ষেত্রেই আরও স্বাধীনতা দাবি করবে।
তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস ‘কনিষ্ঠ অংশীদার’
তামিলনাড়ুর রাজনীতি বহুলাংশেই আঞ্চলিক। ডিএমকে বা এআইএডিএমকের মতো দ্রাবিড় দলগুলোই এখানে প্রভাবশালী। ফলে কংগ্রেসকে তারা মূলত ‘মৌসুমি মিত্র’ বলেই বিবেচনা করে।
বিহারের ফলাফলের পর ডিএমকে আরও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবে—কংগ্রেস কেবল কনিষ্ঠ অংশীদারই থাকবে। আসন বণ্টন বা প্রচারের কৌশল কোনো ক্ষেত্রেই কংগ্রেসের দর-কষাকষির সুযোগ নেই। ডিএমকে (দ্রাবিড় মুন্নেত্র কাজাগম) নেতৃত্ব ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে, কংগ্রেস যেন নতুন কোনো মিত্র, যেমন অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ থালাপতি বিজয়ের দল তামিলাগা ভেটরি কাজগমের দিকে ঝুঁকতে না পারে।
সম্প্রতি তামিলনাড়ুর উপমুখ্যমন্ত্রী উদয়নিধি স্টালিনের মন্তব্য—হাত (কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক) তাদের ছেড়ে যাচ্ছে না—ইতিমধ্যে রাজনৈতিক মহলে জোর গুঞ্জন তুলেছে। বিশ্লেষকদের মতে, বার্তা পরিষ্কার—ডিএমকের ছায়া থেকে বের হওয়ার ক্ষমতা কংগ্রেসের নেই।
কেরালার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত কংগ্রেস
রাজনৈতিক বিশ্লেষক টি জে শ্রীলালের মতে, কেরালায় বিজেপি এখনো কোনো ভিত্তি খুঁজে পায়নি। তাই কেরালায় বিজেপি কোনো হুমকি নয়। ২০২৬ সালের নির্বাচনে মূলত ক্ষমতাসীন বাম গণতান্ত্রিক জোট (এলডিএফ) ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত গণতান্ত্রিক জোটের (ইউডিএফ) সরাসরি লড়াই হবে।
কিন্তু কেরালায় কংগ্রেসের ভেতরে এখন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব তীব্র। বহু নেতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন। কংগ্রেস এমপি শশী থারুর জুলাই মাসে একটি জরিপ শেয়ার করেছিলেন, যেখানে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী পদে দেখতে চান বলে উল্লেখ ছিল। এতে নেতৃত্বের টানাপোড়েন আরও প্রকাশ্যে আসে।
এ ছাড়া মল্লিকার্জুন খাড়গেকে সভাপতি প্রার্থী করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর পর থেকে থারুরের সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিষয়টি সামনে এনে কংগ্রেস নেতা কে মুরলিধরন মন্তব্য করেছিলেন—‘থারুর আগে ঠিক করুন, আপনি কোন দলের!’
টি জে শ্রীলালের মতে, রমেশ চেন্নিথালা ও কেসি বেণুগোপালও মুখ্যমন্ত্রী হতে চান।
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বলেন, ‘কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হওয়ার জন্য তাদের হাতে আসা কোনো সুযোগই কাজে লাগাতে পারেনি। এলডিএফ যদি পরপর তৃতীয় মেয়াদে কেরালার ক্ষমতায় ফিরে আসে, তবে আমি অবাক হব না।’ বিহারের ফল স্পষ্ট করে দিয়েছে, রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ এখন আর নয়াদিল্লির ঘোষণার ওপর নয়, বরং দলটি কত দ্রুত ও কার্যকরভাবে তাদের রাজ্য স্তরের সাংগঠনিক কাঠামোকে ঠিক করবে, তার ওপরই বেশি নির্ভর করবে।
আইএএনএস থেকে সংক্ষেপে অনূদিত