জ্বর আসলে কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ মাত্র। আমাদের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৬ দশমিক ৫ থেকে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শরীরের তাপ বেড়ে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপর চলে গেলেই সেটা জ্বর।
জরুরি কথা
জ্বরে দেহের তাপমাত্রা বেশি থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। শিশু ও শারীরিকভাবে অক্ষম মানুষদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। এ ছাড়া যেসব উপসর্গ থাকতে পারে
সেগুলো হলো:
- মুখ লাল হয়ে যাওয়া
- ত্বক শুকনো ও গরম হওয়া
- প্রস্রাব কম ও গাঢ় হওয়া
- খেতে অনিচ্ছা
- কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া
- বমি ভাব ও বমি
- মাথা ধরা ও সারা শরীর ব্যথা
- বুক ও পেট গরম হওয়া
- শীত শীত লাগা
- ঘাম হওয়া
- ত্বক লাল হওয়া
জ্বরের পেছনে লুকিয়ে থাকতে পারে জটিল অসুখ, তাই সতর্ক থাকা প্রয়োজন। আজকাল সামান্য ঠান্ডা লাগলেও জ্বর হয়। আবার পেটে বা ফুসফুসে সংক্রমণ হলেও শরীরে জাঁকিয়ে বসে জ্বর। জ্বরের কারণ অনেক। তাই বলা হয় জ্বর আলাদা কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ।
জ্বর অনেক কারণেই হতে পারে
তবে জ্বর হলেই বলা যায় না কেন জ্বর হচ্ছে। এর অন্তর্গত কারণ আছে। আর সেটাই হয়তো মূল রোগ। যেসব কারণে জ্বর হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে, সেগুলো হলো:
- ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস সংক্রমণ
- অ্যালার্জি বা বিশেষ খাবার কিংবা ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে
- ঋতু পরিবর্তন হলে
- আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হলে
- ফ্লু ও নিউমোনিয়া
- রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস
- হিট স্ট্রোক
- ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি
- কোভিড (ইত্যাদি)
জ্বর কেন হয়
কোনো সংক্রমণ হলে আমাদের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে জীবাণু তাড়ানোর চেষ্টা করে। আমাদের দেহে স্বাভাবিক তাপমাত্রার বেশি হলে জ্বর হয়, বিজ্ঞানের ভাষায় এটি হাইপারথারমিয়া বা পাইরেকসিয়া।
কী বোঝা গেল? জ্বর মানে শরীর সংক্রমণ থেকে আমাদের সুস্থ রাখার জন্য চেষ্টা করছে। দেহে তাপমাত্রা ১০০ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলেই সাধারণত জ্বর ধরা হয়। মস্তিষ্কের একটি অংশ হলো হাইপোথ্যালামাস, যা নিয়ন্ত্রণ করে দেহের তাপ। তাই একে বলে বডি থারমোসট্যাট।
কোনো সংক্রমণ বা কোনো অসুস্থতা হলে তাতে সাড়া দেয় হাইপোথ্যালামাস। আর তখন হাইপোথ্যালামাস দেহের তাপকে পুনঃস্থাপিত করে। তাই জ্বর হলো এমন লক্ষণ, যা দেখে বোঝা যায় কিছু একটা ঘটছে দেহের ভেতর।
আজকাল কোভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গু বা ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া এসব হচ্ছে। অতিমারির আতঙ্কে অনেকে করাচ্ছেন কোভিড টেস্ট। ডেঙ্গু আর কোভিডের জ্বরে আছে তফাত। ডেঙ্গু হলে হাড়ের গিঁটে খুব ব্যথা হয়। তাই আগে একে বলা হতো হাড়ভাঙা জ্বর। এতে শরীরের বিভিন্ন অংশ হতে পারে লাল। কোভিড জ্বর হলে শরীর, হাত-পা ব্যথা হলেও খুব বেশি ব্যথা হয় না। কোভিড হলে জ্বর, শ্বাসকষ্ট, কাশি, গলাব্যথা হয়। ডেঙ্গুতে এমন উপসর্গ কম। তবে একটি বিষয়, মৃদু হলে এদের পার্থক্য করা কঠিন। তাই চিকিৎসকেরা দিতে পারেন বাড়তি টেস্ট।
মানুষের শরীরের মধ্যে হচ্ছে বিপাক ক্রিয়া। এর ক্রিয়া-বিক্রিয়া চলার সময় বেড়ে যেতে পারে তাপমাত্রা। সব মানুষের দেহের তাপমাত্রা এক রকম হয় না। গায়ে হাত দিলে জ্বর জ্বর ভাব মনে হলেও পরে দেখা যায়, শরীরের তাপমাত্রা কম।
জ্বরের সঙ্গে যা থাকতে পারে
শরীরে কাঁপুনি, ক্ষুধাহীনতা, পানিশূন্যতা, বিষণ্নতা, অতি অল্পে শারীরিক যন্ত্রণা, অবসন্নতা, ঘুম ঘুম ভাব।
জ্বর বেশি হলে কেউ কেউ
প্রলাপও বকতে পারে। এসব দেখে অভিজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলতে পারেন জ্বরের উৎস কী।
চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার আগে
- জ্বর হলে পানিশূন্যতা হয়। তাই প্রচুর পানি পান করতে হবে এবং তরল খাবার খেতে হবে।
- বিশ্রাম নিতে হবে। কায়িক শ্রম জ্বর বাড়িয়ে দেয়।
- হালকা পোশাক পরুন। ঘর যেন গরম না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন।
প্রতিরোধ
- হাত বারবার ধুতে হবে এবং নাক, মুখ, চোখ ছোঁয়া যাবে না।
- অন্যের সঙ্গে নিজের ব্যবহার করা জিনিসপত্র ভাগাভাগি করা যাবে না।
- সহজে হজম হয় তেমন খাবার
খেতে হবে।
জ্বরের সাধারণ তথ্য
একজন প্রাপ্ত বয়স্কের জ্বরে তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে এবং তিন মাসের কম শিশুদের মলাশয়ের তাপমাত্রা ১০০ দশমিক ৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
৩ থেকে ৬ মাসের শিশুদের মলাশয়ের তাপমাত্রা বেশি, খুব মেজাজ খারাপ বা ঘুম ঘুম ভাব হলে চিকিৎসক দেখাতে হবে।
৬ থেকে ২৪ মাসের শিশুদের তাপ ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি এবং সঙ্গে কফ, কাশি বা ডায়রিয়া হলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
২ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জ্বর হলে এবং জ্বরের সঙ্গে র্যাশ, অস্বস্তি, খিটখিটে ভাব, উদাসীন, অবসন্ন, মাথা ধরা, গলা শক্ত, বারবার বমি বা ডায়রিয়া ও খিঁচুনি হলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
জ্বর কমানোর ওষুধ খেয়েও জ্বর না কমলে চিকিৎসক দেখাতে হবে।
কোভিড রোগীর সংস্পর্শে থেকে জ্বর এলে চিকিৎসকের পরামর্শে চলতে হবে।
লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ