খাগড়াছড়ির সিন্দুকছড়ির পাহাড়ঘেরা এক ছোট্ট গ্রাম। সবুজ প্রকৃতির বুকে বেড়ে ওঠা প্রিয়াঙ্কা ত্রিপুরার শৈশব কাটে দারিদ্র্য, আশ্রয়ের সংকট আর পারিবারিক শোকের ছায়ায়। কেউ কল্পনাও করতে পারেননি, এই মেয়ে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। কিন্তু প্রতিকূলতা প্রিয়াঙ্কাকে থামাতে পারেনি; বরং সংগ্রামই তাঁকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি এনে দিয়েছে।
দুঃখ-দুর্দশার শৈশব
তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত প্রিয়াঙ্কা পড়াশোনা করেন স্থানীয় একটি ব্র্যাক স্কুলে। সংসারের একমাত্র ভরসা ছিলেন তাঁর মা, যিনি সীমিত আয়ে সংসার ও শিক্ষার ব্যয় সামলাতেন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে কিছুদিনের জন্য পড়াশোনা থেমে যায় তাঁর। পরে আবার নতুন করে ভর্তি হন বাজারপাড়া ব্র্যাক স্কুলে। জীবনের চাকা বারবার থেমেছে, তবে প্রিয়াঙ্কা থেমে থাকেননি।
আশ্রমের দিনগুলো
প্রিয়াঙ্কা মামা প্রতীরঞ্জন ত্রিপুরা তাঁকে ভর্তি করান চট্টগ্রামের ‘প্রবর্তক সংঘ শিশু সদন’ অনাথ আশ্রমে। আবার তৃতীয় শ্রেণি থেকে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাযাত্রা। আশ্রমের জীবন ছিল কঠিন। অন্যরা যখন ঘুমিয়ে পড়ত, তখন তিনি সিঁড়িতে, বারান্দায় কিংবা খালি চেয়ারে বসে অল্প আলোয় পড়াশোনা চালিয়ে যেতেন। নিদ্রাহীন রাতগুলো যেন তাঁকে আরও দৃঢ় করে তোলে। সেই অধ্যবসায়ের কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ অর্জন করেন।
শোকের ছায়া
শৈশবে বাবাকে হারিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। পরে দ্বিতীয় বড় বোনের অকালমৃত্যু তাঁকে গভীর শোকে নিমজ্জিত করে।
উচ্চশিক্ষার পথে লড়াই
উচ্চমাধ্যমিকের পর প্রিয়াঙ্কার একটাই লক্ষ্য ছিল—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। ঢাকায় কোচিং শুরু করলেও অর্থাভাবে এবং নানা প্রতিকূলতার কারণে মাত্র দুই মাস পরই ঢাকা ছাড়তে হয় তাঁকে। ফিরে যান চট্টগ্রামে। সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী অরঙ্কা ত্রিপুরা তাঁর আবাসনের ব্যবস্থা করে দেন। সেখানে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে অবশেষে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগে ভর্তি হন প্রিয়াঙ্কা। নতুন স্বপ্ন তখন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন
বর্তমানে তিনি ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। জীবনের লড়াই এখনো শেষ হয়নি, তবে তাঁর চোখে এখন নতুন স্বপ্ন। তিনি ভবিষ্যতে একজন আদর্শ শিক্ষিকা অথবা সফল ব্যাংকার হতে চান। তবে শুধু নিজের জন্য নয়, পাহাড়ি এলাকার পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোই তাঁর প্রধান লক্ষ্য। অর্থনৈতিক দুর্বলতা বা সুযোগের অভাবে যেন আর কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থেমে না যায়—এটাই তাঁর স্বপ্ন।
পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বার্তা
পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রিয়াঙ্কা ত্রিপুরা বলেন, ‘পাহাড়ের জীবন কঠিন এবং সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলে। তবে দারিদ্র্য বা প্রতিকূলতা কখনোই আমাদের থামাতে পারে না, যদি ইচ্ছাশক্তি থাকে। সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই কোনো না কোনোভাবে পথ দেখান। পৃথিবীতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো মানুষও এখনো রয়েছেন। তাই আমাদের সাহসী হতে হবে, অধ্যবসায়ী হতে হবে এবং পড়াশোনার মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের আগ্রহকে চিরজাগ্রত রাখতে হবে।’