জুলাই মাসে রপ্তানি আয়ে চাঙাভাব ফিরলেও আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ভাটা পড়েছে দেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে; বিশেষত সেপ্টেম্বর মাসে আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি আয় কমেছে ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। আগস্টে রপ্তানি আয় কমেছে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ। তবে জুলাইয়ের ২৪ দশমিক ৯০ শতাংশের বড় উত্থানে তিন মাস মিলিয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশে। কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই প্রবৃদ্ধির আড়ালে জমছে উদ্বেগ। কারণ, প্রধান বাজারে ট্যারিফের চাপ এবং নতুন অর্ডার কমে আসা একসঙ্গে প্রভাব ফেলছে পণ্য রপ্তানিতে। অবশ্য ভুয়া রপ্তানি আয় কমার মতো ইতিবাচক পদক্ষেপও সার্বিক রপ্তানি আয় কমার জন্য দায়ী।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৩৬২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই আয় ছিল প্রায় ৩৮০ কোটি ২৯ লাখ ডলার। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার।
তবে একক মাসে রপ্তানি আয় কমলেও সামগ্রিকভাবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এই সময়ে মোট রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ২৩১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার বেশি।
ইপিবির পরিচালক (নীতি ও পরিকল্পনা) আবু মোখলেছ আলমগীর হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাস মূলত ট্রানজিশন পিরিয়ড। এ সময় ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে অর্ডার কম থাকে। তা ছাড়া মূল্যস্ফীতি বাড়ায় ক্রেতারা পোশাক পণ্য কম কিনেছে। রপ্তানির এই ধীরগতি আরও এক মাস চলতে পারে।’
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, কেবল মৌসুমি ট্রানজিশন নয়, মার্কিন ট্যারিফ এবং ভুয়া রপ্তানি আয়ের পতনও প্রবৃদ্ধিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্যারিফ আরোপের প্রভাব এখন স্পষ্ট। এটি দীর্ঘায়িত হলে দেশের রপ্তানির জন্য তা উদ্বেগজনক।’
রপ্তানিতে বরাবরের মতোই শীর্ষে রয়েছে তৈরি পোশাক খাত। সেপ্টেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় এসেছে ২৮৩ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ কম। তবে তিন মাসের হিসাবে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯৭ কোটি ৪ লাখ ডলার, গত বছর একই সময়ে ছিল ৯৫১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার।
অন্য খাতগুলোর চিত্রও মিশ্র। সামগ্রিক রপ্তানি কমেছে কৃষিপণ্যে ২.৩৭%, পাট ও পাটজাত পণ্যে ১.০৪%, গৃহস্থালির পণ্যে ০.৫৪% কমেছে। উল্টো প্রবণতা দেখা গেছে প্রিন্টেড ম্যাটেরিয়ালস ও ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যে। এগুলোতে যথাক্রমে ৫৭.৫০ ও ৩৬.৪৩% এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৩.৫৫% প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
রপ্তানি আয় কমে যাওয়া প্রসঙ্গে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ধাক্কার প্রভাবে পোশাক রপ্তানি সেপ্টেম্বরে ৫.৬৬% কমেছে। একদিকে ক্রেতার নতুন অর্ডার মিলছে না, অন্যদিকে অতিরিক্ত ২০% রেসিপ্রোকাল শুল্কের একটি অংশ রপ্তানিকারকদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে মার্কিন ক্রেতারা, যা বিশাল চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, ডলার সংকটের প্রভাবও রয়েছে। তা ছাড়া ইইউসহ অন্যান্য বাজারেও প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে। কারণ, চীন ও ভারত যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এই বাজারগুলোতে আগ্রাসীভাবে রপ্তানি বাড়াচ্ছে; যা বাংলাদেশের জায়গা সংকুচিত করে দিচ্ছে।’
একইভাবে বিজিএমইএর সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ‘বায়াররা এখনো দ্বিধায় আছে। প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে আমরা এমনিতেই পিছিয়ে, তদুপরি আগের তুলনায় ভুয়া রপ্তানিও কমেছে। ফলে সামগ্রিক রপ্তানি আয় কমেছে।’