কিছু মানুষ গল্প হয়, আর কিছু মানুষ নিজের জীবনের গল্প দিয়ে বদলে দেয় অন্যদের জীবনও। সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কবিহারের সন্তান রেজাউল করিম তেমনই একজন। একসময়ের হতাশাগ্রস্ত, বেকার যুবক থেকে হয়ে উঠেছেন সমাজ বদলের এক নিঃশব্দ সৈনিক। আজ তিনি শুধু নিজের ভাগ্যই গড়েননি, হয়ে উঠেছেন অন্যের জন্য অনুপ্রেরণা।
রেজাউলের গল্প শুরু হয় একদম নিচু জায়গা থেকে। এসএসসি পাসের পরই অর্থের অভাবে থেমে যায় পড়াশোনার পথ। সংসারের দায়িত্ব, বেকারত্ব, বিয়ের পর বাড়তি চাপ—সব মিলিয়ে জীবন একসময় হয়ে ওঠে ভারী বোঝার মতো। ‘মাঝেমধ্যে মনে হতো, আমি বুঝি পরিবারে একটা বোঝা’—নিজেই বলেন রেজাউল।
২০১৭ সাল তার জীবনে মোড় ঘোরানো এক বছর। সেবার যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ ও সহজ শর্তে ঋণের খবর পান। গবাদি পশু পালন, হাঁস-মুরগি, প্রাথমিক চিকিৎসা, মৎস্যচাষ, কৃষি—বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ আর মাত্র ৬০ হাজার টাকার ঋণ নিয়েই শুরু করেন যাত্রা। গরু ও মুরগির খামার দিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ে তাঁর আয়। পাশাপাশি আত্মবিশ্বাসও বাড়তে থাকে।
পরে গবাদি পশুর চিকিৎসাবিষয়ক তিন মাসের কোর্স করেন। এখন নিজেই দক্ষ পশু চিকিৎসক। তবে তাঁর খামার আর সেখানেই সীমাবদ্ধ নেই। গরু-মুরগির পাশাপাশি রয়েছে মাছের চাষ, কৃষিকাজের নানা পরিকল্পনা। তাঁর সবচেয়ে বড় সম্পদ—মানুষের ভালোবাসা। কারণ তিনি শুধু নিজের জন্য আয় করেন না, সমাজের জন্যও কাজ করেন।
গ্রামে গাছ লাগান এবং বিতরণ করেন। বাল্যবিবাহ, মাদক, জুয়া—এসবের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালান। এ কারণেই স্থানীয়রা তাকে ভালোবেসে ডাকেন ‘মানবিক ডাক্তার’।
রেজাউলের বৃদ্ধ বাবা আব্দুল খালেক বলেন, ‘একসময় সংসার চালাতে হিমশিম খেতাম, আজ গর্ব করে বলতে পারি—আমার ছেলের মতো ছেলে কয়জনের হয়?’
রেজাউল বলেন, ‘নিজের জীবন থেকেই বুঝেছি, অসহায়ত্ব কেমন। তাই চাইছি আমার খামারটা আরও বড় হোক। যেন অন্তত ১০-১৫ জন যুবক এখান থেকে উপার্জনের সুযোগ পায়।’
তার প্রতিবেশীরাও বলেন, আগে ভাবতাম এসব প্রশিক্ষণে কিছু হয় না। রেজাউলকে দেখে বিশ্বাস এসেছে—ইচ্ছা থাকলে পথ হয়।
কাজীপুর উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. জুলফিকার আলম বলেন, ‘কর্মের উত্তাপে জীবনের জমে থাকা বরফও গলে। রেজাউল তারই এক উজ্জ্বল উদাহরণ। আমি তাঁর প্রকল্প নিজ চোখে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তিনি আমাদের সমাজের একজন আইকন। আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করি।’