হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের সামনে ড্রাম থেকে ২৬ টুকরা অবস্থায় আশরাফুল হকের লাশ উদ্ধারের খবর জানার পর থেকে রংপুরের বদরগঞ্জের গোপালপুর নয়াপাড়া গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। নম্র, ভদ্র ও দানশীল হিসেবে পরিচিত আশরাফুলকে কে বা কারা এভাবে খুন করল, তা বুঝে উঠতে পারছেন না গ্রামবাসী।
আজ শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, পুরো গ্রাম নিস্তব্ধ। বাড়ির দরজায় নির্বাক বসে আছেন বাবা আব্দুর রশিদ। মা এছরা খাতুন শয্যাশায়ী। ঘরের ভেতর স্ত্রী লাকী বেগমের আহাজারিতে ভারী পরিবেশ। সাবেক ইউপি সদস্য আমজাদ হোসেন বলেন, ‘কাঁচামালের বড় ব্যবসায়ী ছিলেন আশরাফুল। দুই ঈদে গরিব মানুষের মধ্যে শাড়ি–লুঙ্গি ও খাবার বিতরণ করতেন। কোরবানির ঈদে গরু কিনে মাংস দিতেন। তাঁর কোনো শত্রু ছিল না। ঢাকায় কেন তাঁকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করা হলো, বুঝতে পারছি না।’
মাদ্রাসা ও মসজিদের নামে দান করা জমির পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবেশী মতিয়ার রহমান বলেন, ‘মঙ্গলবার জমি লিখে দেওয়ার আগে নতুন ঝুল (সাইনবোর্ড) তৈরি করলেন, ৬০ হাজার ইটের বায়নাও দিলেন। সেই মানুষটাকে টুকরা টুকরা করে দিল ড্রামে! দোষটা কী ছিল তাঁর?’
জানা গেছে, আশরাফুলের কোনো ভাই নেই, চার বোন আছে। বাবা ছোট ব্যবসায়ী ছিলেন। শৈশব থেকে বাবার সঙ্গে কাঁচামাল ব্যবসায় যুক্ত হন আশরাফুল। তাঁর একটি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে (১৩) ও পাঁচ বছরের ছেলে রয়েছে। গ্রামের নুর আলম বলেন, ‘ছোট থেকে সংগ্রাম করে সম্পদ করেছেন আশরাফুল। মঙ্গলবার রাতেই প্রবাসী বন্ধু জরেজ ইসলামের সঙ্গে ঢাকায় যান। পরদিনই শুনি তাঁকে ২৬ টুকরা করা হয়েছে।’ গৃহবধূ সুমি বেগম বলেন, ‘বিপদে আমরা তাঁর কাছে যেতাম। কখনো ফিরিয়ে দিতেন না। সেই মানুষটাকে এভাবে কুচি কুচি করা হলো!’
বাবা আব্দুর রশিদ বলেন, ‘মঙ্গলবার বিকেলে আমাকে হাসপাতালে দেখতে আসে আশরাফুল। সঙ্গে ছিল জরেজ। আমি বলেছিলাম, আমাকে হাসপাতালে রেখে ঢাকায় যাইও না। কিন্তু জরেজ খুব তাগাদা দিচ্ছিল ঢাকায় যাওয়ার। জরেজকে ধরলেই খুনের রহস্য বের হবে।’
আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার জন্য আমার স্বামীর কাছে ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন জরেজ। মঙ্গলবার তিনিই আমার স্বামীকে ঢাকায় নিয়ে যান। পরে ফোন করলে স্বামীর ফোন ধরেন জরেজ। বলেন, “আপনার স্বামী ফোন রেখে কালেকশনে গেছে।” আমার স্বামীকে উনিই খুন করেছেন। আমি কঠোর শাস্তি চাই।’
আজ দুপুরে জরেজের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী উম্মে কুলসুম বলেন, ‘স্বামী ১২ বছর মালয়েশিয়া ছিলেন, দেড় মাস আগে দেশে এসেছেন। আশরাফুল তাঁর ছোটবেলার বন্ধু। মঙ্গলবার তিনি বললেন, আশরাফুলের কাজে চট্টগ্রামে যাচ্ছেন। পরে জানালেন, পৌঁছে গেছেন। গতকাল (বৃহস্পতিবার) আশরাফুল খুনের খবর শুনে স্বামীকে ফোন দিই। তিনি বলেন, “আমি জড়িত না। আমাকে চট্টগ্রামে রেখে আশরাফুল বের হয়ে গেছে।” রাতে বাড়ি ফিরবেন জানালেন, এর পর থেকে ফোন বন্ধ।’ কুলসুম জানান, গতকাল রাত সাড়ে ৩টার দিকে বদরগঞ্জ থানা-পুলিশ এসে তাঁর শ্বশুর আজাদুল মোয়াজ্জেমকে নিয়ে যায় এবং বাড়ির দুটি ফোন জব্দ করে।
এদিকে আশরাফুলকে দাফনের জন্য মাদ্রাসা–মসজিদের পাশেই কবর খোঁড়া হয়েছে। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত লাশ বাড়িতে পৌঁছায়নি। বদরগঞ্জ থানার ওসি এ কে এম আতিকুর রহমান বলেন, ‘খুনের ঘটনা ঢাকায়, মামলা হবে ঢাকায়। আমরা একজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এনেছি। ঢাকা ডিবির টিম তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আমরা সহযোগিতা করছি।’