রাজশাহীর বাঘায় বিশ থেকে পঁচিশ বছর বয়সী বড় বড় আমবাগান কেটে ফেলছেন চাষিরা। আম বাগান কাটার এ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে কয়েক বছর ধরে। আমের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে আম গাছ কেটে ফেলছেন বলে জানিয়েছেন বাগান মালিকেরা। তবে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলছেন, আমবাগান কাটা হলেও সেসব স্থানে লাগানো হচ্ছে নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের রপ্তানিযোগ্য আমগাছ।
এদিকে আমবাগান কেটে সবজিসহ নানা আবাদ করছেন চাষিরা। আবার অনেকে স্ট্রবেরি, পেয়ারা ও কুল চাষেও ঝুঁকছেন। আমবাগান উজাড় করে অনেকেই ওই জমি স্ট্রবেরি, পেয়ারা ও কুল চাষের জন্য বছর হিসাবে চড়া দামে ভাড়া (লিজ) দিচ্ছেন। এরই মধ্যে পুরোনো অনেক আমবাগান কেটে খনন করা হয়েছে পুকুর, বাড়ানো হয়েছে আবাদযোগ্য জমি। এতে লাভবান হচ্ছেন তাঁরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। তাতে ফজলি ল্যাংড়া, ক্ষীরসাপাত, গোপালভোগ, লক্ষণভোগ অম্র রুপালীসহ বেশ কিছু নতুন জাতের আম বাগান করা হয়েছে। গড়ে বছরে সর্বাধিক ১২ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। এর মধ্যে আম গাছের সংখ্যা ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩০০। এ বছরে শতাধিকের উপড়ে আম বাগান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক চাষিরা পুরোনো এসব আমবাগান কেটে উচ্চফলনশীল বিভিন্ন নতুন জাতের আম চাষে ঝুঁকেছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, আম বছরে একবারই ফলে। ভালো হলে বাগান মালিক ভালো টাকা পায়। কিন্তু এক দশক ধরে নওগাঁ, সাতক্ষীরা, রংপুর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া ও বান্দরবান পার্বত্য এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা জাতের আম উৎপাদন হচ্ছে। ফলে চাহিদার তুলনায় বেশি এলাকায় আম উৎপাদন হওয়ায় বাজার হারাচ্ছে আম। ক্রমাগত আর্থিক লোকসানে নিরুপায় চাষিরা বাগান কাটছেন। ফলে রাজশাহীর বাঘার প্রসিদ্ধ সুমিষ্ট ঐতিহ্যবাহী আম নির্ভর অর্থনীতি ধ্বংস হতে চলেছে জানান চাষিরা।
আজ রোববার সরেজমিন কথা হয় দিঘা গ্রামে আব্দুল বারী সঙ্গে। তিনি জানান, আম গাছ কেটে দেড় বিঘা জমিতে গমের চাষ করেছিলেন। সকল খরচ বাদে তাঁর ৩৫ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। পরবর্তীতে জমিতে পাট ও ধানের চাষ করবেন।
উপজেলার দিঘা গ্রামের বাগান মালিক আবুল কালাম আজাদ। আট বিঘা জমির বাগান থেকে পরিচর্যা খরচ বাদে বছরে দেড় লাখ টাকা ঘরে তুলতেন। কয়েক বছর ধরে খরচই তুলতে পারেননি তিনি। এ কারণে সম্প্রতি বাগানের শতাধিক গাছ কেটে ফেলেছেন তিনি। এখন সে জমিতে নানা রকম ফসল চাষ করছেন।
উপজেলার বারুদিপাড়া গ্রামের আম চাষি মজিবর রহমান সম্প্রতি তার বাগানের ছোট-বড় এক শ গাছই কেটে ফেলেছেন। সরেরহাট গ্রামের মোমিনুল ইসলাম হিটলার ও তার চাচার কয়েক বিঘার আমবাগান কেটে ফেলেছেন।
শুধু তাই নয়, অন্য জেলাগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আম বিক্রি করা, সেই সঙ্গে ৫২ কেজি মন ধরে ঢলন পদ্ধতিতে আম বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের। চাষিরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ক্রমবর্ধমান সময়ে চাষযোগ্য আবাদি জমি কমেছে। এরই মধ্যে শস্য জাতীয় ফসলের আবাদ ভালো হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাজার দর ভালো পাওয়ায় জমির লিজ মূল্যে বিঘা প্রতি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এতে আম বাগানের চেয়ে নিজে আবাদ করলে অথবা লিজে কৃষকের ভালো করছেন।
উপজেলার পানিকামড়া গ্রামের আমবাগানের মালিক শফিকুল ইসলাম ছানা জানান, চাহিদার কথা বিবেচনা করে নতুন জাতের রপ্তানিমুখী আমের বাগান করেছেন। বিগত বছরগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ঘন পদ্ধতিতে বাগান করে স্বপ্ন দেখছেন।
আমচাষি জিল্লুর রহমান ও অরুণ কুমার জানান, এ পদ্ধতিতে অসময়ে অল্প জায়গায় কম পরিচর্যা ও কম খরচে বেশি আম পাওয়া যাবে। বাগানের ১০টি আম গাছ কেটে ৩০০ হাইব্রিড আম গাছ লাগিয়েছি। এতে উৎপাদন পরিমাণে বেশি হবে। পরিচর্যা খরচও কম।
আম চাষি আব্দুল কুদ্দুস জানান, বাগান পরিচর্যা খরচ বেশি হওয়ায় এবং কয়েক বছর ধরে আমের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। তিনি ৫ বিঘা বাগান কেটে ফেলেছেন। ওই জমি এক বছরে বিঘাপ্রতি হিসাবে ২৫ হাজার টাকা করে জন্য ভাড়া দিয়েছেন। এতেই তাঁর ভালো আয় হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, উপজেলায় অলাভজনক পুরোনো বড় আম গাছ কাটা হচ্ছে। আমবাগান কাটা হলেও সেসব স্থানে লাগানো হচ্ছে নতুন উচ্চ ফলনশীল জাতের রপ্তানিযোগ্য আমগাছ। তাই আমবাগান যেমন বাড়ছে, তেমনি উৎপাদনও বাড়ছে।