হোম > সারা দেশ > রাজশাহী

পাহাড়িয়া সম্প্রদায়

শুক্রবার খাওয়ানো হবে খাসি জবাই করে, রোববার ছাড়তে হবে ঘর

 রিমন রহমান, রাজশাহী

বিষণ্ন মনে বাড়ির আঙিনায় বসে রয়েছেন বৃদ্ধা। ছবি: আজকের পত্রিকা

খাসি জবাই করে সবাইকে ভরপেট খাওয়ানো হবে। তারপর মহল্লার বাসিন্দারা একদিন সময় পাবেন জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে। আগামী রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) তাঁদের ঘর ছাড়তে হবে। ৫৩ বছর বসবাসের পর এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন তাঁরা। আগামী শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) এ ভোজের আয়োজন হবে রাজশাহীর মোল্লাপাড়া এলাকার ‘আদিবাসীপাড়া’য়। পাড়াটির অবস্থান রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫৩ বছর আগে এখানে ১৬ কাঠা জমির ওপর বাড়ি করে পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ছয়টি পরিবার। তিন প্রজন্মে ছয়টি বাড়ি এখন ১৬টি হয়েছে। পাড়াটি স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘আদিবাসীপাড়া’ হিসেবে পরিচিত। এত দিন পর এখন এ জমির মালিকানা দাবি করছেন সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি। তিনি পাহাড়িয়াদের উচ্ছেদ করে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জায়গাটি দখলের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। সাজ্জাদের চাপে ইতিমধ্যে তিনটি পরিবার জায়গা ছেড়ে চলে গেছে। এখন ১৩টি পরিবার রয়েছে। আগামী রোববার তাদেরও এ পাড়া ছেড়ে যেতে হবে।

পাড়ার বাসিন্দাদের দাবি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী পরিবার ভারতে চলে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর তারা দেশে ফিরে আর বাড়িঘর পায়নি। তখন ইন্দ্র ধুপি নামের এক ব্যক্তি তাঁর ১৬ কাঠা জমিতে ছয়টি পরিবারকে বাস করতে দেন। ইন্দ্র ধুপি অনেক আগে মারা গেছেন। মহল্লার মানুষের সুবিধার জন্য সিটি করপোরেশন এখানে দুটি পাকা শৌচাগার নির্মাণ করে দিয়েছে। একটি নলকূপও বসিয়ে দেওয়া হয়। এত দিন পর এখন সাজ্জাদ আলী নামের এক ব্যক্তি দাবি করছেন, ইন্দ্র ধুপি মৃত্যুর আগে এ জমি তাঁর কাছে বিক্রি করে গেছেন। এখন ঘর ছাড়তে হবে সবাইকে।

পাড়ার বাসিন্দা মিশ্র রাম বর্মণ (৪০) জানান, বছর দুয়েক আগে সাজ্জাদ আলী তাঁদের বাড়ি ছাড়তে বললে তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম দুই পক্ষকে নিয়ে বসেছিলেন। সেখানে সাজ্জাদ আলীর কাগজপত্র দেখে কাউন্সিলর বলেছিলেন, এ দলিল জাল। তখন কৌশলে কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে পালিয়ে যান সাজ্জাদ আলী। এরপর তাঁদের আর উচ্ছেদের চেষ্টা করা হয়নি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর সাজ্জাদ আলী ফের মহল্লায় এসে সবাইকে ঘর ছাড়তে বলেন। পাহাড়িয়ারা বাড়ি ছাড়তে না চাইলে একপর্যায়ে কিছু টাকা নেওয়ার প্রস্তাব দেন সাজ্জাদ।

মিশ্র রাম বর্মণ বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন যে আমরা কারও কাছে যেতে পারছি না। কাউন্সিলরও নেই। তাই চিন্তাভাবনা করে টাকা নিতে রাজি হলাম। সাজ্জাদ হাজি বললেন যে যুদ্ধের পর ছয়টা পরিবার ছিল, ওই ছয় পরিবার ধরে ৫ লাখ টাকা করে দেবে। এখন তাঁর ছেলেরা টাকা ভাগ করে নেবে। আমরা ৫০ লাখ করে চাইলাম। কিন্তু সাজ্জাদ হাজি ৬ লাখের বেশি উঠল না। এখন ছয় বাড়ির প্রতিটিকে ৬ লাখ টাকা করে দিচ্ছে। মানে বাড়িতে যদি তিনটি ছেলে থাকে, তাহলে ২ লাখ টাকা করে পাবে। এ টাকা নিয়েই চলে যেতে হচ্ছে।’

মিশ্র রাম জানান, বাড়ি ছাড়তে প্রথমে তিন মাস সময় দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৫ দিন, ৭ দিন ও ১০ দিন করে সময় দেওয়া হয়েছে। মাসখানেক আগে টাকাও দেওয়া হয়েছে। সর্ব শেষ ১০ দিনের সময় শেষ হবে আগামী শুক্রবার। সেদিন খাসি কেটে খাওয়ানো হবে বলে সাজ্জাদ আলী জানিয়েছেন। এরপর আগামী রোববারের মধ্যে তাঁদের এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।

এ মহল্লায় প্রথম যে ছয়জন বাড়ি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে শুধু ফুলমনি বিশ্বাস বেঁচে রয়েছেন। বয়স আনুমানিক ৮০ বছর। আজ বুধবার দুপুরে বিষণ্ন মনে তিনি বসে ছিলেন বাড়ির সামনে। জায়গা ছাড়তে হবে, এখন কোথায় যাবেন—প্রশ্ন করতেই পাল্টা প্রশ্ন করে বৃদ্ধ ফুলমনি বিশ্বাস বললেন, ‘কোথায় যাব? আমরা তো এখুন আন্ধার ঘরে হাইতড়্যাই তো পাছি ন্যা। আন্ধার ঘরে মানুষ কিছু পায় কি না? ওই রকম আমরাও কিছু খুইজে পাছি ন্যা।’

ফুলমনি বিশ্বাসের মেয়ে সরলা বিশ্বাসের (৪৫) জন্মও হয়েছে এ মহল্লায়। সরলা বলেন, ‘এখানেই জন্ম, এটাই ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা তো অন্যায় মনে করলাম। কিন্তু কিছু করার নাই। ১৬ ঘরের মধ্যে তো তিনটা ঘর চলেই গেল। জায়গাটা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এখন দালান উঠবে।’

মহল্লায় ঘুরে দেখা গেল, রুবেল বিশ্বাস, শান্ত বিশ্বাস ও রিংকু বিশ্বাস ঘরবাড়ি ভেঙে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে চলে গেছেন। তাঁরা আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে মহল্লার বাসিন্দারা জানালেন। তাঁরা নিজেরাও এখন একই রকম প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কেউ কেউ অন্য জায়গায় গ্রামের দিকে একটু জমি কিনেছেন। কিন্তু বাড়ি করার টাকা হাতে নেই।

মহল্লার বাসিন্দা পার্বতী রানী গর্ভবতী। বললেন, ‘আমি পোয়াতি। এখুন কার বাড়িত গিয়ে উঠব?’ এ মহল্লার তরুণ শিপেন বিশ্বাস এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছেন। শিপেন জানালেন, এ মহল্লায় প্রথম বাড়ি করা ছয়জনের একজন তাঁর দাদা বামনা পাহাড়িয়া। এখানেই জন্ম তাঁর বাবা টুনু বিশ্বাসের। তাঁরাও রোববারের পর এ জমি ছেড়ে চলে যাবেন।

জানতে চাইলে সাজ্জাদ আলী বলেন, ‘ওই জায়গা আমার কেনা। কেনার সময়ই কয়েকটা ঘর ছিল। এখন তাদের আমি পুনর্বাসন করছি। টাকাও দিয়ে দিয়েছি। তারা বাড়িঘর করছে। এত দিন পর তারা চলে যাবে, এ জন্য শুক্রবার একটা খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করেছি। আমি কাউকে কষ্ট দিচ্ছি না। জোর করে উচ্ছেদও করছি না। সুন্দরভাবেই বিদায় দিচ্ছি।’

কত সালে জমি কিনেছেন—এ প্রশ্নে সাজ্জাদ আলী বলেন, এটা এখন মনে নেই। এলাকার সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম দলিল জাল বলেছিলেন কি না, জানতে চাইলে বলেন, এটা মিথ্যা কথা। অনেক আগে কেনা জমি থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের তিন দিন পর কেন উঠতে বললেন, জানতে চাইলে সাজ্জাদ বলেন, ‘আমি দলটল করি না। ওঠাতে গেলে প্রস্তুতির তো ব্যাপার আছে। পুনর্বাসনের টাকা আগে ছিল না। টাকা ম্যানেজ করেই গিয়েছি।’

বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সিটি করপোরেশনের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। নগরের কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল বারী বলেন, ‘এ রকম কোনো বিষয় আমার জানা নেই। আমাকে কেউ জানায়নি। অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হলে পাহাড়িয়ারা আমার কাছে আসতে পারে। আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’

আরও খবর পড়ুন:

মৎস্যজীবী পরিচয়ে পুকুর ইজারা যুবলীগ নেতার

সেলিম রেজার মনোনয়নে কনকচাঁপার ‘আলহামদুলিল্লাহ’

কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা বাদ, বিএনপির মনোনয়ন পেলেন সেলিম

ঈশ্বরদীর মা কুকুরকে দেওয়া হলো দুই ছানা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষককে বরখাস্ত, পাঁচ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার

রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় শিশু নিহত, মহাসড়ক অবরোধ

রাজশাহীর রাজবাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ করল প্রশাসন

সাংবাদিকদের তালাবদ্ধ রাখার হুমকি দেওয়া যুবশক্তির দুই নেতাকে অব্যাহতি

রাজশাহীর ১১ পয়েন্টে পুলিশের ফোর্স মোবিলাইজেশন ড্রিল

রাজশাহীতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো রাজবাড়ী