উত্তরের জেলা গাইবান্ধা সাতটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এর মধ্যে সুন্দরগঞ্জ, সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা—এই চারটি উপজেলা চরবেষ্টিত। এসব চরে প্রায় ৫ লাখ মানুষের জীবন কাটে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, ভূমিক্ষয়, বন্যা, ঝড় আর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে। নদীভাঙনের ধাক্কা সামলে টিকে থাকতে তাঁদের এক চর থেকে অন্য চরে ছুটে বেড়াতে হয়।
এই পিছিয়ে থাকা মানুষের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নারীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে বসতবাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ, হাঁস-মুরগি ও ভেড়া পালন শুরু করেছেন। এতে নিজেদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি বাড়তি আয় করে ভাগ্যবদলের স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা।
দুর্যোগে চরের মানুষের ধানের বীজতলা, মাঠের ফসল, ঘরবাড়ি, গরুর খাবার, খড়ের গাদা পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ফ্রেন্ডশিপসহ কয়েকটি এনজিও এগিয়ে এসেছে। ফ্রেন্ডশিপের ট্রান্সিশন ফান্ড (এএসডি) প্রকল্পের সহায়তায় এসব পরিবার বসতভিটায় সবজি চাষ এবং ভেড়া, হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেছে। তাতেই পাল্টে যাচ্ছে তাঁদের জীবনমান।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার মোল্লারচর ইউনিয়নের মাইজবাড়ী চরের এফডিএমসির সদস্য আসমা বেগম ফ্রেন্ডশিপের প্রকল্প থেকে ৩ হাজার ৬০০ টাকা মূল্যের একটি ভেড়া পেয়েছিলেন। সেই ভেড়া থেকে এখন তাঁর পাঁচটি ভেড়া হয়েছে। বাজারে এগুলোর দাম প্রায় ৩২ হাজার টাকা।
মালেকা বেগম বলেন, ‘আধুনিক পদ্ধতিতে শাকসবজি উৎপাদনের প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর আমার বসতবাড়িতে সবজি উৎপাদন করে এ বছর ৫ হাজার ১০০ টাকার সবজি বিক্রি করেছি, যা আমার সংসারের ব্যয়ভার বহনে খরচ হচ্ছে এবং আমি সবজি বিক্রির ৮ হাজার টাকায় একটি ছাগল কিনেছি।’
গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের কড়াইবাড়ী চরের মুনসুরা বেগম বলেন, ‘আগে অবহেলিত ছিলাম। ভেড়া পেয়ে এখন স্বাবলম্বী হওয়ার পথে। একটা ভেড়া দিয়ে শুরু করে বর্তমানে আমার ৩০টি ভেড়া হয়েছে। এ ছাড়া শাকসবজি চাষ করি। নিজে খাই, বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করি।’
আম্বিয়া বেগম নামের একজন বলেন, একসময় পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ ছিল। এনজিও থেকে একটি ভেড়া পেয়ে সেটি থেকে একাধিক হয়েছে। এরই মধ্যে কয়েকটি ভেড়া বিক্রি করে পরিবারে বেশ সচ্ছলতা ফিরেছে।
চরের নুরুল ইসলাম, রাশেদা বেগম ও মিনারা বেগম বলেন, ‘আগে বাজার থেকে সার কিনতে হতো, এখন আমরা নিজেরাই কম্পোস্ট সার তৈরি করি। পোকামাকড় দমনে ব্যবহার করি ফেরোমন ফাঁদ। সরকারি সেবা পেতে বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করি। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধেও কাজ করছি।’
তাঁরা আরও বলেন, ঘন ঘন দুর্যোগ মোকাবিলা, অবকাঠামো উন্নয়ন, সরকারি সহায়তা ও সচেতনতা বাড়াতে আরও কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
ফ্রেন্ডশিপের প্রকল্প ব্যবস্থাপক দিবাকর বিশ্বাস বলেন, ‘চরাঞ্চলের পিছিয়ে থাকা নারীদের ভেড়া ও সবজি চাষে স্বাবলম্বী করতে আমরা সহায়তা দিচ্ছি। বীজ, প্রযুক্তিগত সহায়তা—সবই বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। গাইবান্ধার চরাঞ্চলে দেশি ভেড়ার বীজ থেকে উন্নত জাত তৈরির কাজ চলছে। এই জাতের ভেড়া দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।’
গাইবান্ধা জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘চরাঞ্চলে ভেড়া পালন খুবই লাভজনক। জেলায় সমতল এলাকায় ৭৪ হাজার ভেড়া রয়েছে। চরাঞ্চলে চারণভূমি থাকায় ভেড়া পালন সহজ এবং এতে বাড়তি শ্রমিকও লাগে না।’