পরপর দুটি বিকট শব্দ, কেঁপে ওঠে পুরো পুরান ঢাকা। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মুহূর্তেই ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় সিদ্দিক বাজারের তিনটি ভবন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ধসে পড়া দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে ১০টি প্রাণ ঝরে পড়ে। শুধু ভবনের ভেতরেই নয়, বাইরে সড়কেও মানুষের মৃত্যু হয়।
এদের মধ্যে পথচারী, বাসযাত্রী, দোকান কর্মচারী ও ব্যাংকের কর্মচারী রয়েছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকর্মীরা জানান।
আজ মঙ্গলবার বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে সিদ্দিক বাজারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সরণির ৫ ও ৬ নম্বর ভবনে বিস্ফোরণ হয়। ভবন দুটির পাশেই একটি বিদ্যুতের ট্রান্সমিটার ছিল, সেটিও বিস্ফোরিত হয়।
৫ নম্বর ভবনটি পাঁচতলা, আর কুইন সেনিটেরি মার্কেট নামে পরিচিতি ৬ নম্বর ভবনটি আট তলা। এই ভবনের বেইজমেন্টে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস।
কুইন সেনিটেরি মার্কেট ভবনের মালিক রেজাউর রহমান নামে প্রয়াত একজন। তাঁর তিন ছেলে ওয়াহিদুর রহমান, মশিউর রহমান ও মতিউর রহমান উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক। মেজো ভাই মশিউর লন্ডনপ্রবাসী। বাকি দুই ভাই ভবনটি পরিচালনা করেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ওয়াহিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিস্ফোরণের শব্দে ভবন কেঁপে উঠে, সিঁড়ি ভেঙে যায়। পরে ছাদে গিয়ে পাশের ভবন দিয়ে নিচে নেমে আসি। সবাই তখন চিৎকার করে কাঁদছিল। বড় দুটি শব্দ হয়েছে; মুহূর্তেই আমার কান বন্ধ হয়ে যায়।’
ওয়াহিদুর জানান, ভবনটির বেইজমেন্ট থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত স্যানিটারি পণ্যের দোকান। চার তলা থেকে আবাসিক ফ্ল্যাট। দুই ইউনিট করে মোট আটটি ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি সপরিবারে ভবনের চার তলায় থাকেন।
ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেসন্স ও ম্যান্টেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘ভবনের সেফটি ট্যাংক থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে বলে আমাদের প্রাথমিক ধারণা। তবে তদন্তের পর কারণ জানা যাবে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, গুলিস্তান বিআরটিসির বাস স্ট্যান্ডের পর সদরঘাটের দিকে যেতে একটি ভবন রেখেই হাতের বামপাশে তিনটি ভবনেরই দেয়াল ভেঙে পড়েছে; ভাঙা কাচ সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভবন তিনটি ঘিরে রেখেছে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসেরর সদস্যরা।
সড়কটি সারা দিন যানজট লেগেই থাকে; বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল করে। পথচারী, রিকশাযাত্রী, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্যানিটারি জিনিসপত্র কিনতে এখানে খুচরা দোকানিরাও আসেন।
রাজধানীর মালিবাগ থেকে আসা ফয়সাল নামে এক দোকান কর্মচারী রিকশা ভ্যানে করে বৈদ্যুতিক ফ্যান নিয়ে ফিরছিলেন। বিস্ফোরণের সময় তিনি ঘটনাস্থলের আশেপাশে ছিলেন, তার ভ্যানটি ২০ গজের মতো দূরে দাঁড়ানো ছিল।
ঘটনার বর্ননা দিয়ে ফয়সাল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিকট দুটি শব্দ হল, এরপর কানে কিছু আর শুনিনি। কেবল দেখলাম ধুলা, সবাই জিরো পয়েন্টের দিকে দৌড়াচ্ছে। চিৎকার করছে মানুষ। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ভবনের সামনে এসে দেখি আমার ফ্যানসহ ভ্যান পরে আছে; ভ্যান চালককে পাচ্ছি না।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) বিপ্লব কুমরা সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখনো ভবনের বেইজমেন্ট ধ্বংস্তুপ হয়ে আছে। প্রতিটি তলায় উদ্ধার অভিযান চলছে। অনেকেই আটকা থাকতে পারেন বলে ফায়ার সার্ভিসের ধারণা।
বিস্ফোরণের ঘটনায় হাসপাতালে মোট ১৫ জনের মরদেহ রয়েছে বলে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানিয়েছেন। এদের মধ্যে ১০ জনের লাশ ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করেছে। বাকিরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। অর্ধশতাধিকের বেশি আহত ব্যক্তি জরুরি বিভাগে রয়েছেন।
আরেকটি ভবনের নীচ তলায় স্যানিটারির দোকান, দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ব্রাক ব্যাংকের গুলিস্তান শাখার অফিস। এই ভবন থেকেও একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বামপাশের সাত তলা ভবনটির ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়েছে। ভবন তিনটি থেকে সবাইকে সরিয়ে নিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। প্রতিটি তলায় তল্লাশি করে দেখছে ফায়ার সার্ভিস।
বিশেষশজ্ঞ প্রকৌশলী আসার পর ফের উদ্ধার অভিযান শুরু হবে। ফায়ার সার্ভিস বলছে, ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া ভেতরে অভিযান চালানো ঝুকিপূর্ণ হতে পারে।
উদ্ধার অভিযানের জন্য ঘটনাস্থলে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ঘটনার পর পুরো গুলিস্তান ও সিদ্দিক বাজার বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে।