দীর্ঘ ৩৫ বছর কুয়েতের প্রবাসজীবন শেষ করে পাঁচ বছর আগে দেশে ফিরে আসেন আব্দুল মান্নান মজুমদার। জীবনের বাকিটা সময় পরিবারের সঙ্গে পার করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ৫ নভেম্বরের একটি সড়ক দুর্ঘটনা তাঁর সাজানো সংসার তছনছ করে দিয়েছে। সেদিনের সেই দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান আব্দুল মান্নানের স্ত্রী, দুই মেয়েসহ আরও দুই স্বজন। গুরুতর আহত একমাত্র ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহেদ মজুমদার লিসানকে বাঁচাতে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়ান তিনি। কিন্তু মৃত্যুর কাছে হার মেনে গত বুধবার সন্ধ্যায় পরপারে পাড়ি জমান লিসানও। এক ঝড়ে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন আব্দুল মান্নান। গতকাল বৃহস্পতিবার ছেলের লাশ আনার পর থেকে চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকার দক্ষিণ ফালগুনকরা গ্রামের বাড়িতে শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন আব্দুল মান্নান। চোখে নেই কোনো পানি। অবাক দৃষ্টিতে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন তিনি ভাষাহীন এক মানুষ। আজ শুক্রবার সকালে জানাজা শেষে লিসানের লাশ দাফন করা হয়।
৫ নভেম্বর সকালে চট্টগ্রামমুখী মারসা পরিবহনের একটি বাসের সঙ্গে কক্সবাজারমুখী মাইক্রোবাসের সংঘর্ষ হয়। চকরিয়া উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের হাঁসের দীঘি আর্মি ক্যাম্পের অদূরে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে নিহত হন আব্দুল মান্নানের স্ত্রী রিজিওনা মজুমদার শিল্পী, মেয়ে ফারজানা মজুমদার লিজা, ফারহানা মজুমদার টিজা, লিজার শাশুড়ি রুমি বেগম ও ননদ সাদিয়া পাটোয়ারী। গত বুধবার সন্ধ্যায় রাজধানীর নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একমাত্র ছেলে লিসানও মারা যান। এ ঘটনায় আহত হয় নাতি ফায়াজ আব্দুল্লাহ সানাফ ও জামাতা উদয় পাটোয়ারী।
গতকাল সকালে সরেজমিনে আব্দুল মান্নানের বাড়িতে দেখা যায়, লিসানের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের সামনে একটি চেয়ার নিয়ে বসে আছেন আব্দুল মান্নান। কারও সঙ্গে কথা বলছেন না তিনি। ফ্যালফ্যাল করে মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সন্তানের লাশ পাহারা দিচ্ছেন। হয়ে গেছেন নীরব, নিস্তব্ধ ও শোকে পাথর।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আব্দুল মান্নান দীর্ঘ ৩৫ বছর কুয়েতে প্রবাসজীবন কাটিয়েছেন। প্রবাসে কঠোর পরিশ্রম করে সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ছিল আব্দুল মান্নানের সাজানো সংসার। তাদের জন্য করেছেন ডুপ্লেক্স বাড়ি। বড় মেয়ে ফারজানা মজুমদার লিজাকে বিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী চান্দিশকরা গ্রামে। তাঁর ঘরে ছিল চার বছর বয়সের ফুটফুটে নাতি ফায়াজ আব্দুল্লাহ সানাফ। ছোট মেয়ে ফারহানা মজুমদার টিজা মাস্টার্স শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন আর একমাত্র ছেলে লিসান মজুমদার বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। পাঁচ বছর আগে দেশে ফেরেন আব্দুল মান্নান। পরিবারের সঙ্গে জীবনের বাকিটা সময় কাটাতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সুখ যেন কপালে সইল না। এক দুর্ঘটনায় সবাইকে হারালেন তিনি। আব্দুল মান্নান হয়ে গেলেন একা।
আব্দুল মান্নানের ভাতিজা নাছির মজুমদার বলেন, ‘আমার চাচার সাজানো-গোছানো সংসার এক সড়ক দুর্ঘটনায় তছনছ হয়ে গেল। তাঁর নিজের বলতে আর কিছুই রইল না। একে একে পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন চাচা। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন এখন পর্যন্ত ঘাতক বাসচালককে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা চাই, প্রশাসন দ্রুত বাসচালককে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসুক।’
মালুমঘাট হাইওয়ে পুলিশের ইনচার্জ মো. মেহেদী হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় মারসা যাত্রীবাহী পরিবহনের চালকের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে। দুর্ঘটনার পর থেকে চালক পলাতক। তবে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তাকে আমরা গ্রেপ্তার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’