শীর্ষ সন্ত্রাসীদের দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক নেতাদের বিরোধ এবং চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তারকে ঘিরে একের পর এক লাশ পড়ছে চট্টগ্রামে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড ঘটছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দ্বন্দ্বে। রাজনৈতিক দলের কোন্দলের বলিও হয়েছেন কয়েকজন। এত খুনোখুনির পরেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা হুংকারেই সীমাবদ্ধ। সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র ব্রাশফায়ারের নির্দেশ দিচ্ছেন সিএমপি কমিশনার, খুনিরা আছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে জনমনে।
গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়কের কাছে গুলি করে হত্যা করা হয় যুবলীগ কর্মী মো. আনিস এবং মাসুদ কায়সারকে। এই দুই হত্যাকাণ্ডের জন্য নগরীর শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদ হোসেন ওরফে ছোট সাজ্জাদকে প্রধান আসামি করে পৃথক দুটি মামলা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, সাবেক শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ আলী (বড় সাজ্জাদ) ভারতে বসে এই দুজনের লাশ ফেলার নির্দেশ দেন।
চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার চালিতাতলী এলাকায় ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় গুলিতে নিহত হন শীর্ষ সন্ত্রাসী সরোয়ার হোসেন বাবলা। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহর সঙ্গে চট্টগ্রাম-৮ আসনের নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে যাওয়া বাবলাকে সেদিন কয়েক শ মানুষের মধ্যেই ঘাড়ে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত খুনিদের পরিচয় প্রকাশ কিংবা মূল হত্যাকারীদের ধরতে পারেনি পুলিশ।
বাবলা হত্যার পরদিন একই এলাকায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালককে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ওই অটোরিকশাচালক মাদক বিক্রির বিরোধিতা করছিলেন বলে জানা গেছে। একই স্থানে পরপর দুবার গুলির ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এক নারীকে দিয়ে হানিট্র্যাপে ফেলে গত ২৫ মে পতেঙ্গায় একসময়কার সন্ত্রাসী মো. আকবর ওরফে ঢাকাইয়া আকবরকে প্রকাশ্যে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আকবর মারা যান। আকবর নগরের বায়েজিদ এলাকার পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, আকবরের বিরুদ্ধে হত্যা, অস্ত্র, চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১০টি মামলা রয়েছে। আকবর সরোয়ার হোসেন বাবলার সহযোগী ছিলেন। আকবর হত্যার পর তাঁর পরিবার পতেঙ্গা থানায় ১১ জনকে আসামি করে মামলা করে। র্যাব এরই মধ্যে বড় সাজ্জাদের
ভাই ওসমান আলী ও ভাতিজা আলভিনকে গ্রেপ্তার করে পরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পতেঙ্গা থানার উপপরিদর্শক অমিতাভ দাস জানান, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি এখনো উদ্ধার করা যায়নি। মামলায় চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও দুজন বর্তমানে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।
এর আগে বাকলিয়া এক্সেস রোডে গত ২৯ মার্চ একটি প্রাইভেট কারে থাকা দুজনকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত বখতিয়ার হোসেন (৩০) ও মো. আবদুল্লাহ (৩২) সরোয়ার হোসেন বাবলার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তখন একই গাড়িতে সরোয়ার হোসেন বাবলাও ছিলেন। সন্ত্রাসীদের টার্গেট বাবলা থাকলেও সেদিন তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় গত ২৭ অক্টোবর রাজনৈতিক ব্যানার ছেঁড়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সময় গুলিতে নিহত হন জিয়াউদ্দিন চৌধুরী কলেজের ছাত্রদল কর্মী মো. সাজ্জাদ (২২)। এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সেদিন চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক বাদশা ও সাবেক সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহর অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। নিহত সাজ্জাদ ছিলেন এমদাদুলের পক্ষের সমর্থক।
এ বিষয়ে বাকলিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক জানান, ‘এই মামলায় আমরা এখন পর্যন্ত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছি এবং কিছু অস্ত্র উদ্ধার করেছি। মামলাটি এখন ডিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।’
গত বছরের ২১ অক্টোবর বিকেলে চান্দগাঁওয়ের অদূরপাড়া এলাকায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন এক ব্যবসায়ীর পুত্র আফতাব উদ্দিন তাহসিন। ৭ নভেম্বর রাতে নগরের হালিশহর মাইজপাড়া এলাকায় মোটরসাইকেলে করে আসা কয়েকজন যুবকের ‘ছুরিকাঘাতে’ মো. আকবর (৩৫) এক যুবক খুন হন।
নগরের একের পর এক হত্যাকাণ্ড এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে সিএমপির মুখপাত্র ও সহকারী কমিশনার আমিনুর রশিদ বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনাকে আমরা স্পর্শকাতর হিসেবে নিয়ে তদন্ত করছি। অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। যারা পলাতক, তাদের ধরার জন্য সর্বাত্মকভাবে কাজ করছি।’