উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় দুর্যোগপ্রবণ জেলা বরগুনা। বিপুল সংখ্যক মানুষের পেশা মাছ শিকার। তাঁদের বসবাসও নদী তীরবর্তী এলাকায়। অনিশ্চয়তার জীবনে আরেক বিপর্যয় হয়ে হানা দিয়ে কোভিড মহামারি। এক দিকে দারিদ্র্য, অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কেউ আর মেয়েকে ঘরে রাখাটা ‘নিরাপদ’ মনে করছেন না। মোটামুটি পছন্দ মতো পাত্র পেলেই স্কুলপড়ুয়া কিশোরী মেয়েকে গোপনে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।
সম্প্রতি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, করোনা কালে বরগুনায় রেকর্ড সংখ্যক বাল্যবিবাহ হয়েছে। ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত জরিপে দেখা গেছে, এ সময় বরগুনা জেলায় ১ হাজার ৫১২ টি বাল্যবিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। ২১ জেলার মধ্যে এটিই সর্বাধিক। এরপরই যথাক্রমে কুড়িগ্রাম (১ হাজার ২৭২ টি), নীলফামারী (১ হাজার ২২২ টি), লক্ষ্মীপুর (১ হাজার ৪১ টি) এবং কুষ্টিয়া (৮৮৪ টি) জেলার অবস্থান।
করোনাকালীন অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক সুরক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বন্ধ থাকা, তথ্যের আদান প্রদানে ঘাটতি সৃষ্টি হওয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টানা বন্ধ থাকার কারণে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো–অর্ডিনেটর অর্পিতা দাস জানান, উপকূলীয় জেলা বরগুনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নআয়ের মানুষেরা কন্যাশিশুটিকে ঝুঁকি মনে করে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে মহামারি কালে রোজগারের সমস্যা, দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাসহ নানা সামাজিক প্রতিকূলতার কারণে তাঁরা বাল্য বিয়ের দিকে বেশি ঝুঁকছেন।
কিশোরী কন্যাকে বিয়ে দেওয়া কয়েকজন অভিভাবকের বক্তব্যেও এই বিষয়গুলো উঠে এসেছে। সম্প্রতি মেয়েকে বাল্যবিয়ে দিয়েছেন বরগুনার সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী গ্রামের এক বাসিন্দা। দশম শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে পার্শ্ববর্তী গ্রামে বিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ভাই, মোরা অইলাম জাইল্লা (জেলে) মানুষ, গাঙ্গে মাছ ধইর্যা খাই। মাইয়া ইশকুলে পড়াইতাম, দুইডা বচ্ছর ইশকুল বন্ধ। মাইয়া ডাঙ্গর (বড়) অইছে, হেই চিন্তায় ঘুম আয়না। পোলাপানে জ্বালায়, মাইয়া মানু কতকুন মন ঠিক রাকতে পারে (মেয়ে মানুষ কতোক্ষণ মন ঠিক রাখতে পারে)। একটা বিপদ ঘটাইয়া হালাইলে, ইজ্জাত থাকপে না। হের চাইতে পোলা পাইছি, বিয়া দিয়া দিছি।’
নদী তীরবর্তী জেলেপাড়াগুলোর বাসিন্দা তো বটেই, অন্য এলাকার নিম্নআয়ের মানুষগুলোও একই রকম যুক্তি দিচ্ছেন। সদরের নলটোনা ইউনিয়নের নবম শ্রেণী পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকেও সম্প্রতি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে। ওই শিক্ষার্থীর অভিভাবক একজন অটোরিকশা চালক। তিনি বলেন, ‘করোনায় গুরাগারা (বাচ্চাকাচ্চা) লইয়া খাইয়া পইরা থাকনই দায়। এইয়ার মইদ্দে ইশকুল বন্ধ থাহনে মাইয়া জিবুইত (মানুষ) ঠিক রাহন দায়। চিন্তা হরলাম, বিয়া দেওনই ভালো। হেই কারণে মোর মাইয়া বিয়া দিয়া নিশ্চন্ত অইছি।’
বরগুনায় বাল্যবিয়ের রেকর্ড নিয়ে কথা হয় সামাজিক সংগঠন নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ কমিটি বরগুনা জেলার সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের সহযোগিতা ছাড়া বাল্যবিয়ে সংঘটিত হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কাজিদের কাছে বিয়ের জন্য গেলেই বয়স প্রমাণ করতে জন্ম নিবন্ধন সনদ দরকার হয়। টাকার বিনিময়ে ইউপি সচিবেরা জন্ম নিবন্ধন দিয়ে থাকেন। ফলে আইনগত কোনো জটিলতায় পড়তে হয় না। জন্ম নিবন্ধন জোগার করতে না পারলে বিয়ে হওয়া সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সচেতনতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই।
তবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জরিপে পাওয়া পরিসংখ্যান মানছেন না জেলা মহিলা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মেহেরুন মুন্নি। তিনি বলছেন, তাদের তথ্যের সঙ্গে আমাদের কাছে থাকা তথ্যের কোনো মিল নেই। বরগুনায় বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়েছে তবে এত বেশি না। আমরা করোনার মধ্যে শতাধিক বাল্যবিয়ে বন্ধ করেছি। অবশ্য করোনার কারণে সচেতনতামূলক কার্যক্রম এবং স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষকেরা ছাত্র–ছাত্রীদের খোঁজখবর নিতে পারছেন না, ফলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বাল্যবিয়ের তথ্য আসে না বলে স্বীকার করেছেন এ কর্মকর্তারা। এ ছাড়া মহামারিতে নিম্নআয়ের মানুষেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁরা কন্যাশিশুকে বোঝা মনে করছেন। এসব কারণে বাল্যবিয়ে বাড়ছে বলেও একমত তিনি।