আয়েশা বেগম। সত্তরোর্ধ্ব এই নারী ভালো করে দাঁড়াতে পারেন না। কথা বলতে গেলে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বলেন। তাও তাঁর স্বর যেন বের হতে চায় না, কথা বলার সময় শরীর কাঁপে। কেঁপে কেঁপে যা বললেন, তা যেন সব সীমান্তবাসীর কথা।
এই নারীর বসবাস কক্সবাজারের উখিয়া থানার রহমতের বিল নামক মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায়। গত মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাখাইনে আরকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ বলতে গেলে তাঁর বাড়ির সামনেই ঘটে।
আয়েশা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী কাদের বসু মারা গেছেন বছর দশেক আগে। বড় ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে স্বামীর বাড়িতেই তাঁর বাস। মেয়েকে বিয়ে দিলেও নিজের কাছেই রেখেছেন। বড় ছেলেও থাকেন তাঁর সঙ্গে। মঙ্গলবার রাতভর বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ পান। কোনো রকমে সেদিন রাত পার করেন। সকালে বাংলাদেশ সীমান্ত সড়কের ওপর দিয়ে বুলেট তাঁর ঘরে এসে পড়ে।
আয়েশা বেগম বাড়িতে এসে পড়া গুলি হাতে নিয়ে দেখিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় প্রশ্ন করেন, ‘এই গুলির দানা যদি কারও মাথায় বা গায়ে লাগে, তাহলে সে কি আর বাঁচবে?’ সেদিনই বাড়ি ছেড়ে বালুখালী চলে যান তিনি। পরদিন গোলাগুলি থামার পর বাড়িতে ফেরেন। কিন্তু আতঙ্ক কাটেনি।
রহমতের বিলের উত্তরপাড়ার আরেক বাসিন্দা পারভিন আক্তার কাপড় গুছিয়ে বস্তায় ভরে রেখেছেন। দুই দিন বালুখালীতে ভাইয়ের বাড়িতে ছিলেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে দ্রুত যেন ভাইয়ের বাড়িতে যেতে পারেন, সেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন তিনি।
পারভিন আক্তার বলেন, ‘দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে এখানে কোনোভাবেই থাকা সম্ভব নয়। গুলির শব্দে মাটিতে শুয়ে ছিলাম এক দিন। এরপর আমার ভাই খবর দিলে ভাইয়ের বাসায় চলে যাই।’
বর্তমানে টেকনাফ সীমান্তবর্তী এলাকার মিয়ানমার অংশে যুদ্ধ চলছে। আরকান আর্মিরা বান্দরবান এলাকার সীমান্তবর্তী থেকে রাখাইন রাজ্যে বিজিপি ঘাঁটি ও বিওপি দখল করতে করতে মংডুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তাই দুই তিন-দিন টেকনাফ সীমান্ত অঞ্চলে বড় ধরনের গোলাগুলির আশঙ্কা রয়েছে।
সীমান্তে এই গোলাগুলির কারণে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন কৃষকেরা। মাঠভর্তি ফসল, কিন্তু জমির কাছে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে সীমান্তের ওপার থেকে ছুটে আসায় গুলিতে অন্তত দুজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েকজন।
রহমতের বিল এলাকার রহমতের বিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি কামাল উদ্দিন মিয়াজী বলেন, ‘আমাদের জমিজমা সব সীমান্তবর্তী এলাকায়, কৃষকেরা কাজ করতে পারছেন না, সন্তানেরা বাইরে নামতে পারছে না, স্কুলে যেতে পারছে না, স্কুল বন্ধ। মানুষ নিজের ঘরেও নিরাপদ নয়।’
কামাল উদ্দিন বলেন, ‘সীমান্তের হাজার হাজার মানুষ আতঙ্ক নিয়ে ঘরে থাকছে। কত দিন কোথায় গিয়ে থাকবে মানুষ! এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সরকারের উচিত মিয়ানমারকে জানিয়ে দেওয়া যে, গোলাগুলি যেন বাংলাদেশে না আসে।’
গোলাগুলির কারণে লাখ লাখ টাকার ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেক কৃষক। বীজতলায় কেউ কেউ পানি দিতে পারছেন না। বিজিবি কৃষকদের সীমান্তবর্তী আবাদি জমিতে যেতে নিরুৎসাহিত করছে। তমব্রুর মধ্যমপাড়ার কৃষক মো. তৈয়ব আলী বলেন, ‘১২ থেকে ১৩ বিঘা জমিতে আবাদ করেছি। বাদাম, বেগুন এবং মরিচ চাষ করেছি। বাদাম তোলার সময় হয়েছে কিন্তু তুলতে পারছি না। সময়মতো বাদাম তুলতে না পারলে সব বাদামে গাছ জন্মাবে অথবা ইঁদুরে কেটে ফেলবে। বেগুন লাগানোর পর আর তুলতে পারিনি। কবে খেতে যেতে পারব তাও জানি না।’
বিজিবি-প্রধানের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার পর্যন্ত ২৬৪ বিজিপি সদস্যকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুজন নারী ও দুই শিশু রয়েছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইমিগ্রেশন সদস্য ও অন্যান্য সংস্থার ৩২৭ জন সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাঁদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ সাপেক্ষে নিরাপদ আশ্রয় এবং আহতদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।