লন্ডন থেকে অদূরেই ক্যান্টাবরি শহরে আমার ইউনিভার্সিটি অবস্থিত। এখানে আসার আগে ক্যান্টাবরি শহরটিকে কেবল চিনতাম চসারের ‘ক্যান্টাবরি টেলস’-এর মাধ্যমে। পরে জেনেছি, পাশ্চাত্য রেনেসাঁর অন্যতম রূপকার নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর (১৫৬৪-১৫৯৩) জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শহরেই। লন্ডনের অতি কাছে (ট্রেনে ৪৫ মিনিট, বাসে ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিটের পথ) সমুদ্রসৈকত-সমৃদ্ধ কেন্ট কাউন্টির কেন্দ্রস্থল এই ক্যান্টাবরি শহর। বিগত কয়েক শ বছর ধরে লন্ডনের লেখক-সাহিত্যিক-দার্শনিকদের আনাগোনা ছিল এই শহরের আনাচে-কানাচে। ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত হওয়ায় চমৎকার আবহাওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সমুদ্রসৈকত এর প্রধান আকর্ষণ। কেন্টকে বলা হয় ‘গার্ডেন অব ইংল্যান্ড’। কেন্ট কাউন্টিতে ৫০টির মতো সমুদ্রসৈকত আছে। ক্যান্টাবরির চারপাশ ঘিরে সমুদ্রসৈকত অবস্থিত—যেমন: ফোকস্টোন, ডোভার, ডিল, ব্রডস্টেয়ার, মারগেট, রামসগেট, সেনউইচ, হার্ন বে ইত্যাদি। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার থেকে শুরু করে টি এস ইলিয়ট এখানকার সমুদ্রসৈকতে অবকাশ যাপনে আসতেন। ইংরেজি সাহিত্যের অনেক চরিত্র এখানকার শহরে বেড়ে উঠেছে। ভিক্টোরীয় যুগে অন্যতম লেখক চার্লস ডিকেন্সের (১৮১২-১৮৭০) অনেক চরিত্র ও ঘটনাবলির ছায়া এসব স্থানে পাওয়া যায়।
আমার ডর্মেটরির কাছাকাছি ক্যান্টাবরির বিখ্যাত নদী গ্রেট স্ট বয়ে গেছে। এই নদীর পাড়ে বসেই ইংরেজ কবি থমাস হার্ডি (১৮৪০-১৯২৮) প্রিয়তমা জীবনসঙ্গিনীর বিয়োগব্যথায় লিখেছিলেন: ‘Overlooking the River Stour’ (১৯১৬)। শহরের ভেতর দিয়েই এই নদী প্রবাহিত হয়েছে; যদিও কালের বিবর্তনে শহরের অভ্যন্তরের নদীর অংশ সরু খালের আকার নিয়েছে, তথাপি জলের প্রবহমানতা বিদ্যমান আছে। এই শহরে আগত ভ্রমণপিপাসুদের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার ‘পান্টিং’—লগি দিয়ে নৌকা চালিয়ে পর্যটকদের এই শহর দেখানো; অনেকটা ভেনিসের নৌবিহারের মতো।
একদিন সকালে গ্রেট স্ট নদীর তীর ধরে হাঁটতে বেরোলাম। তখন হঠাৎ চোখে পড়ে রাস্তার ওপর তামার অক্ষরে খোদাই করে লেখা ‘রোমান ওয়াটলিং স্ট্রিট’। পাশে সাইনবোর্ডে ছোট্ট পরিচয় লেখা ‘ইংল্যান্ডের প্রথম রাজপথ’। আকস্মিক কিছু আবিষ্কারের মতো হঠাৎ এই ফলকচিহ্ন দেখে আমার যারপরনাই অবাক হওয়ার পালা। কারণ, পরে এই ‘রোমান ওয়াটলিং স্ট্রিট’ আমাকে হাঁটতে নিয়ে যায় ইংল্যান্ডের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের পথে।
পোপের কাছ থেকে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরি ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। এত দিন পোপ ছিল একমাত্র ‘ডিভাইন রাইট’প্রাপ্ত। রাজা অষ্টম হেনরি নিজেকে একই সঙ্গে চার্চ ও রাষ্ট্রের প্রধান ‘ডিভাইন রাইট’ প্রাপ্ত বলে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা ছিল ইংল্যান্ডের ইতিহাসে যুগান্তকারী। কারণ, হাজার বছর ধরে চলা পাপাসি বা পোপ বা ধর্মগুরুদের একচ্ছত্র ক্ষমতা এতে খর্ব হয়। রাজা অষ্টম হেনরি ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন চার্চ—প্রধান ধর্মগুরুর নামকরণ হয় ‘আর্চবিশপ’। ইংল্যান্ডের ইতিহাস বদলে দেওয়া মাদার অব অল অ্যাংলিকান চার্চের অবস্থান ক্যান্টাবরি শহরে, যা ‘ক্যান্টাবরি ক্যাথেড্রাল’ নামে পরিচিত। মজার বিষয় হলো, রাজা অষ্টম হেনরির এ ঘটনার সূত্রপাত তাঁর বিয়ের বৈধতা নিয়ে। তার যুগান্তরকারী সিদ্ধান্তে রাতারাতি ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠা হাজার হাজার ক্যাথলিক চার্চ বন্ধ হয়ে যায়। পরে এর প্রভাব (ধর্মীয় সংস্কার) ইংল্যান্ডের সমাজ-সংস্কৃতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। প্রোটেস্টান্টদের পালে হাওয়া লাগে।
ডাচ ক্যাথলিক থিওলজিস্ট ও দার্শনিক ডেসিডেরিয়াস ইরাসমাস (১৪৬৬-১৫৩৬) ও মার্টিন লুথার ছিলেন বন্ধু। তাঁরা ওল্ড টেস্টামেন্টের কিছু বিষয় নিয়ে গভীর ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনা করতেন। কিন্তু একসময় তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়। মার্টিন লুথারের ধর্মীয় সংস্কারের চিন্তাধারাই পরে ‘প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন’ নামে পরিচিত হয়। অন্যদিকে ইরাসমাস ল্যাটিন ও গ্রিক ভাষায় ক্রিস্টিয়ান ধর্মের অনেক বিষয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে রিফর্মেশন-কাউন্টার দিতে চেষ্টা করেন। তিনি ক্যাথলিক ধারা বজায় রাখতে আমৃত্যু ব্যাপৃত ছিলেন। রেনেসাঁর সূচনাপর্বে তাঁর অন্যতম অবদান ছিল মানুষের ‘ফ্রিডম অব উইল’ বা ইচ্ছার স্বাধীনতার কথা বলা। এই সময়ে আরেকজন চিন্তাবিদ-দার্শনিক ইংল্যান্ডের সমাজ-সংস্কৃতি পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; তিনি হলেন থমাস মোর (১৪৭৪-১৫৩৫)। ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র ও পলিটিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় তিনি রচনা করেছিলেন যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ইউটোপিয়া’ (১৫১৬)। উল্লিখিত এঁরা সবাই ছিলেন ইংল্যান্ডের রেনেসাঁর প্রথম দিকের ব্যক্তিত্ব। মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্মতাত্ত্বিক বিতর্কের ভেতর দিয়েই মানবিক মূল্যবোধ ও মানবিকতার উন্মেষের সূচনা হয়, যা মূলত রেনেসাঁর বীজমন্ত্র। পরে অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক এই অভিযাত্রায় শামিল হন। সময়ের পরিক্রমায় এর মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ড প্রবেশ করে প্রাক-আধুনিক যুগে, সেখান থেকে আধুনিক যুগে।
এ জন্য তারা গ্রেট স্ট নদীর তীর ধরে লন্ডনের সঙ্গে ক্যান্টাবরি শহরের সড়কপথে যোগাযোগের জন্য চুন-সুরকি দিয়ে রোমান ওয়াটলিং স্ট্রিট নির্মাণ করে। আধুনিক যুগের বিশাল রাজপথের সঙ্গে এটিকে তুলনা করলে ভুল হবে। এই রাজপথ দিয়ে মূলত দুটি গরুর গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলার মতো প্রশস্ত। প্রায় ২ হাজার বছরের পুরোনো সেই রাজপথ এখনো টিকে আছে, যদিও বর্তমানে এটি পিচঢালাই করে ঢেকে রাখা হয়েছে। ইংল্যান্ডে এর আগে কোনো রাজপথের ধারণাই ছিল না। মজার তথ্য হলো, এই ‘রোমান ওয়াটলিং স্ট্রিট’ বা রাজপথের একদিকের অভিমুখ যেমন ছিল লন্ডনের দিকে, অপরটি ছিল পরিভ্রাজক-তীর্থযাত্রীদের শেষ গন্তব্য পথ রোমের দিকে।
প্রাচীন এই পথের একদিকে এগোলে রোম, অপরদিকে হাঁটলে লন্ডন—বিস্ময়কর এক অনুভূতি জাগ্রত হয়। মনে হচ্ছিল, হাজার বছরের পুরোনো সেই মহাসড়কে দাঁড়িয়ে মুহূর্তে ইতিহাসের অলিগলিতে হারিয়ে যেতে বসেছি।
(চলবে)
আরও পড়ুন: