হোম > বিশ্লেষণ

শান্তি স্থাপনের আড়ালে পশ্চিমা ‘কলোনি’ হয়ে উঠবে গাজা

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, গাজায় ট্রাম্পের প্রস্তাব অনুসারে জাতিসংঘের ম্যান্ডেট আসলে অঞ্চলটিকে ফের কলোনি করার আধুনিক উদাহরণ। ছবি: সংগৃহীত

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নতুন অনুমোদিত এক প্রস্তাবে বলা হয়েছে, গাজার আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি সামাল দিতে একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী তার ম্যান্ডেট পালনে ‘সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ নেবে। এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফিলিস্তিনি উপত্যকার নিয়ন্ত্রণে বসাবে। সেখানে বহুজাতিক সেনাদের সমন্বয়ে একটি ‘ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যাবিলাইজেশন ফোর্স বা আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী—আইএসএফ ট্রাম্প ঘোষিত ২০ দফা পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ অবস্থা তদারকি করবে।

ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘ম্যান্ডেট’ শব্দটি বিদেশি হস্তক্ষেপের এক করুণ ইতিহাস। এই শব্দ ফিলিস্তিনিদের কাছে খুবই পরিচিত। ব্রিটিশ–ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লাইম বলেছেন, ‘এটা (জাতিসংঘের অনুমোদন পাওয়া ম্যান্ডেট) একেবারে ক্লাসিক ঔপনিবেশিক নকশা, যা স্থানীয় মানুষের অধিকার ও আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে।’ তিনি বলেন, ‘এই অর্থে, এটি ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ফর প্যালেস্টাইনের সঙ্গে তুলনীয়।’

আন্ডারস্ট্যান্ডিং হামাস: অ্যান্ড হোয়াই দ্যাট ম্যাটারস—বইয়ের লেখক হেলেনা কাবান বলেন, ‘ম্যান্ডেট একটি টেকনিক্যাল শব্দ। কিন্তু পশ্চিম এশিয়ার মানুষের জন্য এর ঐতিহাসিক ভার অনেক বেশি।’ তিনি বলেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে অটোমান অঞ্চলগুলোতে ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে যে ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছিল, তা উপনিবেশবাদী ধারণার ওপর দাঁড়িয়ে ছিল। এসব অঞ্চলের জনগণ নাকি স্বশাসনের জন্য প্রস্তুত ছিল না।’

প্রায় এক শ বছর পর আবারও বৈশ্বিক শক্তিগুলো ‘অস্থায়ী’ সময়ের জন্য ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। জাতিসংঘের ২৮০৩ নম্বর প্রস্তাবটি ১৩–০ ভোটে গৃহীত হয়, দুটি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। দুই বছরের জন্য এক ‘শান্তি পরিষদ’ গঠনের কথা বলা হয়েছে, যা বহুজাতিক সৈন্য, ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট ও স্থানীয় পুলিশকে তত্ত্বাবধান করবে।

হামাস ও অন্যান্য কয়েকটি ফিলিস্তিনি পক্ষ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) উল্লেখযোগ্যভাবে এটি সমর্থন করেছে। এতে ‘ফিলিস্তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা’ বিষয়ে অস্পষ্ট, প্রতিশ্রুতিহীন উল্লেখ আছে। এবং রাষ্ট্র তখনই গঠিত হবে যখন কয়েকটি শর্ত পূরণ হবে।

এই বিষয়ে ব্রিটিশ–ইসরায়েলি বিশ্লেষক ও সাবেক শান্তি আলোচক ড্যানিয়েল লেভি বলেন, ‘যা স্বাভাবিক অধিকার, সেটাকেই শর্তসাপেক্ষ করা হচ্ছে। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে এভাবে বেঁধে রাখা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক আইনের রক্ষক হিসেবে বিবেচিত জাতিসংঘই এখন সেটাকে খর্ব করার কাজ করছে।’

নিরাপত্তা পরিষদের ১৩ সদস্য ছাড়াও, খসড়াটি সমর্থন করেছে বেশ কয়েকটি মুসলিম ও আরব দেশ। এসব দেশের মধ্যে আছে—মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়া। রাশিয়া ও চীন ভোটদানে বিরত ছিল। রাশিয়া যদিও প্রস্তাবটিকে ‘ঔপনিবেশিক’ বলেছে, কিন্তু দেশ দুটির কেউই ভেটো ব্যবহার করেনি।

লেভির মতে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষই এই প্রস্তাব সমর্থন করায়, তা মুসলিম দেশগুলোকে এটি সমর্থন করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আর একই কারণে, এতে রাশিয়া ও চীনেরও ভেটো না দেওয়ার পথ তৈরি হয়। লেভি বলেন, ‘একবার যখন মুসলিম প্রধান দেশগুলো সমর্থন দিয়ে ফেলেছে, তখন আর কেউ আলাদা পথে হাঁটতে চায়নি।’

হামাস প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, নিরস্ত্রীকরণের ধারণা তারা মানে না এবং খসড়াটি ফিলিস্তিনিদের দাবি ও অধিকারের প্রতিফলন ঘটায় না। গোষ্ঠীটির নিরস্ত্রীকরণে অনীহা বহুজাতিক বাহিনীর জন্য বড় সমস্যা তৈরি করবে। জাতিসংঘ অনুমোদিত প্রস্তাবে আইএসএফের যে ‘সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসে” অংশ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই শর্তের অংশ হিসেবে হামাস গাজায় উপস্থিত থাকা অবস্থায় আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষীরা গাজায় গিয়ে এই অভিযান চালাবে—এমন সম্ভাবনা খুবই কম।

আভি শ্লাইম বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ‘দুই বছরের টানা বোমাবর্ষণের পরও হামাসকে নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ’ হয়েছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘তাহলে আন্তর্জাতিক বাহিনী কীভাবে তা করবে? আর কোন আরব দেশ ইসরায়েলের হয়ে এমন কাজ করতে চাইবে?’ তিনি বলেন, মূলত ‘এটি গাজার ওপর অনির্দিষ্ট ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার পরিকল্পনা।’

কাবানও মনে করেন, আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যে এমন দায়িত্ব নিতে অনীহা থাকবে। তিনি বলেন, ‘এত ক্ষমতাধর ইসরায়েলি বাহিনী যদি গাজায় প্রতিরোধ (হামাস) যোদ্ধাদের দমন করতে না পারে, তাহলে আইএসএফ–এ যোগ দেওয়ার কথা ভাবা আরব বা মুসলিম সামরিক বাহিনীর কোনো জেনারেলই তার সেনাবাহিনীকে এ কাজে ঝুঁকাতে চাইবে না।’

হামাস কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছে যে, স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের পর তারা অস্ত্রসমর্পণ ও শক্তিসংহতকরণে রাজি হতে পারে। তাদের সামরিক সক্ষমতাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অংশ হিসেবে রূপান্তর করাও সম্ভব। কাবান বলেন, উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের বহু ঐতিহাসিক উদাহরণেই এমন পথ দেখা গেছে। নিরস্ত্রীকরণে অচলাবস্থার কারণে প্রস্তাব বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে আছে। তবু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এমন একটি পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে, যা ট্রাম্পের তত্ত্বাবধানে এবং আংশিকভাবে ইসরায়েলের আশীর্বাদপুষ্ট—এটাই বড় রাজনৈতিক ঘটনা।

কাবান প্রশ্ন তোলেন কেন নিরাপত্তা পরিষদের এত সদস্য ‘সম্পূর্ণ নতি স্বীকার’ করল এবং কেন রাশিয়া ও চীন ভেটো দিল না। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদে গতকাল যা ঘটেছে, তা জাতিসংঘের জন্য লজ্জা বয়ে এনেছে। সংস্থাটি এবং এর প্রতিনিধিত্বকারী সবকিছু এখন এমন এক সংকটে, যেখান থেকে উঠে আসতে অনেক সময় লাগবে, যদি আদৌ উঠে আসতে পারে আরকি।’

মিডল ইস্ট আই থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!