হোম > বিশ্লেষণ

দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের নিবন্ধ

ইসরায়েল হামাসকে নির্মূল করেনি নাকি করতে পারেনি

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

হামাস সেনারা। ছবি: এএফপি

গাজায় স্থল অভিযানের শুরু থেকে ইসরায়েল জোর দিয়ে বলেছে, তারা ‘চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ’। টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে অবিরাম বিমান হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সময়ও একই অবস্থান ছিল নেতানিয়াহুর সরকারের। এমনকি গত সপ্তাহে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরও একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখাচ্ছে। গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে আনুমানিক ১৫ হাজার হামাস যোদ্ধা আবারও সংগঠিত হয়ে উঠে এসেছে। তাদের অনেকে পূর্ণ সশস্ত্র এবং এরই মধ্যে গাজায় প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা শুরু করেছে। গাজা থেকে প্রাপ্ত প্রতিবেদন বলছে, তারা সন্দেহভাজন সহযোগীদের খুঁজে বের করে প্রকাশ্যে হত্যা করছে। অর্থাৎ হামাস ধ্বংস হয়নি, রক্তাক্ত ও বিভক্ত হলেও সংগঠনটি টিকে গেছে।

এ ফলাফল আসলে অপ্রত্যাশিত নয়। বিশ্বের সব প্রভাবশালী সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞ বহু আগে সতর্ক করেছিলেন, হামাসকে কেবল সামরিক শক্তি দিয়ে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। হামাস শুধু একটি সশস্ত্র নেটওয়ার্ক বা সুড়ঙ্গ ব্যবস্থা নয়, এটি ফিলিস্তিনি সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে বসা একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক আন্দোলন। যেমনটা যুক্তরাষ্ট্র আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ক্ষেত্রে দেখেছে, নেতা হত্যা করা যায়, অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়, এলাকা দখল করা যায়, কিন্তু কোনো আদর্শকে বোমা মেরে ধ্বংস করা যায় না।

ইসরায়েলের ঘোষিত ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ শুরু থেকে ছিল এক মরীচিকা। হামাসের নেতৃত্বকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সংগঠনটি এখনো স্থানীয় সেল ও মিলিশিয়া আকারে সক্রিয়। ইসরায়েলি অভিযানে গাজার অসংখ্য সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত, আবাসিক এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু যেসব মূল কারণ হামাসের উত্থান ঘটিয়েছিল (বঞ্চনা, রাষ্ট্রহীনতা ও হতাশা), সেগুলো আজও বহাল ও আরও তীব্র।

২০০০-এর দশকের শুরুতে ফাতাহ নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার প্রতীকে পরিণত হয়। কয়েক বছরের ব্যর্থ শান্তি আলোচনা, অর্থনৈতিক পতন ও ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিরা পিএর প্রতি আস্থা হারায়। হামাস এ ক্ষোভকে রাজনৈতিক পুঁজি বানায়, নিজেদের পরিচয় দেয় দুর্নীতিমুক্ত, শৃঙ্খলাবদ্ধ, ন্যায় ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে।

২০০৬ সালে গাজায় হামাস নির্বাচনে জয় পায় মূলত ফাতাহর স্থবিরতার কারণে; উগ্র ইসলামপন্থার প্রতি সমর্থন হিসেবে নয়। কিন্তু বিজয়ী হয়ে হামাস ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার চিরাচরিত একনায়কতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের গাজা থেকে উৎখাত করে, নির্বাচন বাতিল করে আর জনগণের কল্যাণে ব্যয় না করে বিপুল অর্থ ব্যয় করে সুড়ঙ্গ, রকেট তৈরি ও সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে।

তবে এখানে ইসরায়েলের নীতির ভূমিকাও উপেক্ষা করা যায় না। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর ও গাজাকে বিভক্ত রাখার নীতি হাতে নেয়। নেতানিয়াহু জানতেন, একটি ঐক্যবদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব দ্বিরাষ্ট্র বাস্তবায়নের প্রস্তাবকে শক্তিশালী করত আর বিভক্ত নেতৃত্ব সেই সম্ভাবনাকে দুর্বল করেছে। এ কৌশলের অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিম তীর পিএকে দুর্বল করার পাশাপাশি গাজায় হামাসের শাসনকে পরোক্ষভাবে মেনে নেওয়া।

এ স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। হামাসকে শক্তিশালী হতে দিয়ে নেতানিয়াহু কার্যত দ্বিরাষ্ট্র সমাধানকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রেখেছেন। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলের জন্য রাজনৈতিক আপসে না গিয়ে বসতি সম্প্রসারণ ও দখল চালিয়ে যাওয়ার পথে এক সহজ অজুহাত ছিল।

কিন্তু এ নীতি ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলায় ভয়াবহভাবে উল্টো ফল দিয়েছে। হামাসের হামলা ইসরায়েলের নিরাপত্তাবোধ ভেঙে দিয়েছে, ভয়াবহ এক যুদ্ধের সূচনা করেছে এবং শান্তিপ্রক্রিয়াকে পুরো এক প্রজন্ম পিছিয়ে দিয়েছে।

গাজার জনগণের মধ্যে হামাসের প্রতি গভীর ভালোবাসা নেই। অনেক ফিলিস্তিনি হামাসকেই দোষারোপ করছে ধ্বংস ও রক্তপাত ডেকে আনার জন্য। কিন্তু বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা বিশ্বাসযোগ্য শান্তির রূপরেখা না থাকায় হামাসের বয়ান টিকে আছে। চরমপন্থা বাঁচে হতাশার ওপর আর গাজায় এখন হতাশার প্রাচুর্য।

হামাসকে প্রকৃত অর্থে পরাজিত করার একমাত্র উপায় অস্ত্র নয়, বরং আদর্শিক লড়াই। হামাস যে বক্তব্যের ওপর টিকে আছে—তা হলো, রাষ্ট্রহীন মানুষের জন্য সম্মানের একমাত্র পথ হচ্ছে সহিংসতা। এ বক্তব্য ভেঙে দেওয়ার একমাত্র উপায় হলো ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি বাস্তব, আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত ও বিশ্বাসযোগ্য দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের পথ তৈরি করা।

এর অর্থ হলো, ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধতা ফিরিয়ে আনা ও একটি নতুন প্রযুক্তিগত বা বহুপক্ষীয় প্রশাসনের মাধ্যমে গাজাকে পুনর্গঠন করা। শহীদ হওয়ার বাসন নয়, শাসন ও উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নেতৃত্বকে ক্ষমতায় আনা। গাজার রাজনৈতিক সংস্কার ও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমার শর্তে যুক্তরাষ্ট্র ও আরব বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোকে তহবিল পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া। ইসরায়েলকেও বুঝতে হবে, স্থায়ী অবরোধ ও দখলদারত্ব নিরাপত্তা বাড়ায় না; প্রকৃত নিরাপত্তা আসে সহাবস্থান থেকে।

ইসরায়েলের অভিযান প্রমাণ করেছে, যেমনটা বিশেষজ্ঞরা বহু আগে বলেছেন, আপনি একটি সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারেন, কিন্তু একটি আদর্শকে নয়। হামাসকে সত্যিকার অর্থে পরাজিত করতে হলে ফিলিস্তিনের নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে ও চিন্তায় বিশ্বাসযোগ্য শান্তি ও সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ দেখাতে হবে।

ন্যাশনাল ইন্টারেস্টে বিশ্লেষণটি লিখেছেন ড. আজিম ইব্রাহিম। তিনি নিউ লাইনস ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসির সিনিয়র ডিরেক্টর এবং ‘অথরিটেরিয়ান সেঞ্চুরি: উইমেনস অব আ পোস্ট-লিবারাল ফিউচার’ বইটির লেখক। অনুবাদ করেছেন আবদুল বাছেদ

পুতিন জানেন—ইউক্রেনের ‘সময় ফুরিয়ে আসছে’, যুদ্ধ শেষের তাড়া নেই

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

শাহেনশাহ-ই-পাকিস্তান: আসিম মুনিরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার স্বপ্ন কি তাসের ঘর

যে ইমরান খানকে আমি চিনতাম—শশী থারুরের স্মৃতিকথায় আশঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলার উত্তেজনায় রাশিয়া ও চীন কেন নীরব

দুবাইয়ে তেজস দুর্ঘটনা: সামনে আসছে ভারতের যুদ্ধবিমান কর্মসূচির পুরোনো দুর্বলতা

হাসিনার ভাগ্যে কী আছে