১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি জাতির ওপর যে বর্বর জেনোসাইড চালিয়েছিল, যাকে এক কথায় বলা যায় ‘জাতিগত নিধন’, সেই নিধনযজ্ঞের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজও মেলেনি। মাঝখানে ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা থেকে খসে পড়েছে ৫১টি বছর!
এত বছরেও কেন স্বীকৃতি মিলল না, সেটি এক প্রশ্ন বটে। তবে কি সেই হত্যাযজ্ঞ ব্যাকরণগত ‘জেনোসাইড’ ছিল না? নাকি ছিল না ‘ম্যাস কিলিং’? সেই হত্যাযজ্ঞকে যে প্রতিষ্ঠান স্বীকৃতি দেবে, সেই জাতিসংঘ নামের প্রতিষ্ঠানটি আসলে কী বলছে?
জাতিসংঘের চোখে ‘জেনোসাইড’
১৯৪৯ সালে এক কনভেনশনে জাতিসংঘ বলেছিল, কোনো জনগোষ্ঠী কিংবা ধর্ম-বর্ণ ও বিশ্বাসের মানুষদের আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার লক্ষ্যে যদি পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক আকারে হত্যা, আক্রমণ ও নিপীড়ন চালানো হয়, তবে তাকে জেনোসাইড বলা হবে। ‘দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’ শীর্ষক ওই কনভেনশনে জেনোসাইডের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিল জাতিসংঘ। বৈশিষ্ট্য পাঁচটি হচ্ছে—কোনো জনগোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন করা, জীবনমানের ওপর আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন করা, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া।
অস্ট্রেলিয়ার পত্রিকা হেরাল্ড ট্রিবিউন এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পঁচিশে মার্চ রাতে শুধু ঢাকা শহরেই ১ লাখ লোককে হত্যা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি ভারতের শরণার্থীশিবিরগুলো পরিদর্শন করেন ১৯৭১ সালে। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে সরাসরি জেনোসাইড চালানোোর অভিযোগ করেন। ‘গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-এ বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে বিশ শতকের পাঁচটি ভয়ংকর জেনোসাইডের অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের ড্যান কগিন, যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক, একজন পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘We can kill anyone for anything. We are accountable to no one. ’ বিশ্বখ্যাত এই পত্রিকার একটি সম্পাদকীয় মন্তব্য ছিল, ‘It is the most incredible, calculated thing since the days of the Nazis in Poland. ’
এনসাইক্লোপিডিয়া আমেরিকানা এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে লিখেছে, বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে নাজি বাহিনীর বর্বরতার চাইতেও ভয়াবহ। এই হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘paint the green of East Pakistan red’; অর্থাৎ, তিনি বাংলার সবুজ মাঠকে লাল করে দেবেন।
এসব তথ্য-প্রমাণ জাতিসংঘ উল্লিখিত ওই পাঁচ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে কি মেলে না? যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষই স্বীকার করবেন যে, মিলে যায়। তার পরও জাতিসংঘের স্বীকৃতি কেন মিলছে না? তার আগে দেখা যেতে পারে, কোন কোন গণহত্যাকে জেনোসাইড বলে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
জাতিসংঘ স্বীকৃত জেনোসাইডগুলো
জাতিসংঘ বেশ কয়েকটি প্রাচীন ও সাম্প্রতিক জেনোসাইডের স্বীকৃতি দিয়েছে। যেমন অটোমানদের হাতে ১৯১৫ সালে ১৫ লাখ আর্মেনীয় হত্যা, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় তুতসি জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর হাতে ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যা, ১৯৯২ সালে বসনিয়া গণহত্যা এবং ১৯৭৫ সালে কম্বোডিয়া গণহত্যা।
এই গণহত্যাগুলোর সঙ্গে ১৯৭১ সালের বাঙালি হত্যার কোনো অমিল আছে কি? পাকিস্তানি বাহিনী তো শুধু ২৫ মার্চ রাতেই গণহত্যা চালায়নি; হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে ৯ মাসজুড়ে। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে জাহীদ রেজা নূর আজকের পত্রিকায় এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘অপারেশন সার্চলাইট ছিল জেনোসাইডের শুরু।’ ওই নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘জেনোসাইডের মাধ্যমে পোড়া মাটি নীতি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার যে দুরভিসন্ধি ছিল ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো গংদের; সেটা পরবর্তীকালে আর পূর্ণতা পায়নি। সেই ইতিহাস ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস।’
৯ মাসের সেই ব্যাপক বিধ্বংসী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালিকে পাকিস্তানিরা যে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল, সেটা তো এখন ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। তার পরও জাতিসংঘ কেন সেই হত্যাকাণ্ডকে জেনোসাইড বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে না?
গলদটা কোথায়?
বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করেছে ২০২১ সালে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে শত শত কোটি টাকা খরচ করে বছরজুড়ে নানা বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে তেমন দৃশ্যমান কোনা উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘বাঙালি গণহত্যার স্বীকৃতি: জাতিসংঘের ব্যর্থতা’ শীর্ষক এক সেমিনার করেছে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম—মুক্তিযুদ্ধ ’৭১। সেখানে এই সংগঠনের নেতারা গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশের সরকারকে অবিলম্বে জাতিসংঘের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদন জানানোর দাবি জানিয়েছেন।
তার মানে বাংলাদেশ এখনো স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদনই করেনি!
গত বছর জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চেভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগেও এখন কেন যেন ভাটা পড়ে গেছে ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারও যেভাবে উৎসবের সঙ্গে শুরু হয়েছিল, এখন তেমন গতি নেই। তাই আমরা এবার ৩০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি ৷ শুধু দেশের নয়, বিদেশেও যাঁরা আমাদের বন্ধু আছেন, তাঁরাও এখানে স্বাক্ষর করবেন ৷ এরপর এই স্বাক্ষরগুলো আমরা জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে পাঠাব। আসলে এত বছর পর গণহত্যার স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব, কিন্তু কঠিন ৷ এ কারণে আমরা আগে জনমত গঠনের কাজে নেমেছি। আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বহুবার বলেছি বন্ধরাষ্ট্রগুলোর কাছে চিঠি পাঠাতে। কিন্তু কেন তারা পাঠায়নি, আমরা জানি না৷ এমনকি ভারতের কাছেও চিঠি পাঠায়নি।’
দৈনিক সমকালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ মার্চকে ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড ডে হিসেবে পালনের প্রস্তাব দিয়ে ২০০৭ সালে ইউনেসকোর কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। তখন ইউনেসকো জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য কোনো প্রস্তাব সরকারিভাবে যেতে হয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো প্রস্তাব ২০১৫ সাল পর্যন্ত যায়নি; বরং ২০১৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত যে ১৯৩টি দেশ ৯ ডিসেম্বরকে জেনোসাইড দিবস পালনের জন্য সর্বসম্মত ভোট দিয়েছিল, তার একটি বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশ ৯ ডিসেম্বরের পরিবর্তে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক জেনোসাইড দিবস পালনের দাবি আর করতে পারে না। ‘জাতিসংঘে এমন প্রস্তাব মোটেই কার্যকর হবে না’ বলে সমকালের কাছে মন্তব্য করেছেন শাহরিয়ার কবির।
সুযোগ এখনো পুরোপুরি হাতছাড়া হয়ে যায়নি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। সুযোগটা নিতে হবে একাত্তরের গণহত্যার পুরো ৯ মাসের স্বীকৃতির। গত বছর দৈনিক প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের পরিচালক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘তিনটি কারণে এখনো আমরা এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে পারিনি। একটি দেশের গণহত্যাকে যে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক মহলে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে ঘাটতি আছে। আমাদের এখানে বেশির ভাগ গবেষণা হয়েছে বাংলায়। গণহত্যা নিয়ে ইংরেজি ভাষায় গবেষণার পরিমাণ খুবই কম। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের উদ্যোগেরও ঘাটতি আছে। গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ আছে। তবে তা আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করি। বর্তমান বিশ্বের প্রধান প্রধান শহর; যেমন লন্ডন, ওয়াশিংটন, বেইজিং, টোকিও, দিল্লি, মস্কো প্রভৃতি স্থানে বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে হবে। জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে। গণহত্যা নিয়ে প্রচুর বই, প্রদর্শনী, প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করতে হবে।’
তবু একটুখানি আলোর দেখা
একাত্তরের গণহত্যা কিংবা শুধুই ২৫ মার্চের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদৌ মিলবে কি মিলবে না, কিংবা মিললেও কত দিন সময় লাগবে—এমন অনিশ্চিত হতাশার মধ্যেও একটুখানি আলোর দেখা মিলেছে। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর অবর্ণনীয় জাতিগত নিধনযজ্ঞকে ‘জেনোসাইড’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন ও জেনোসাইড ওয়াচ। শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছেলে তৌহীদ রেজা নূরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই স্বীকৃতি মিলেছে। লেমকিন ইনস্টিটিউট এ বছরের ১ জানুয়ারি এবং জেনোসাইড ওয়াচ ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে স্বীকৃতির কথা জানায়। বাংলাদেশ জেনোসাইডের ঘটনাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকার করে নিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাসের আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থা দুটি।
এদিকে একাত্তরের গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ায় ‘জেনোসাইড ওয়াচ ও লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ধন্যবাদ’ শিরোনামে গত ৯ ফেব্রুয়ারি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন জাতিসংঘের কাছে স্বীকৃতির জন্য আবেদন করছে না? সমস্যা কোথায়? রাষ্ট্রের এ আচরণ সত্যই রহস্যজনক।
তবে ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ওই বছর সরকারি প্রজ্ঞাপনে ২৫ মার্চকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।