নিজেকে ‘শান্তির প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে দাবি করলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম বছরেই মার্কিন সামরিক বাহিনী বিশ্বের অন্তত সাতটি দেশে শক্তিশালী বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। সংঘাত পর্যবেক্ষণ সংস্থা আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটার (এসিএলইডি) তথ্যমতে, ২০ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে বছরের শেষপর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা মিলে বিভিন্ন দেশে ৬২২টির বেশি বোমা হামলা চালিয়েছে। সর্বশেষ ক্রিসমাস চলাকালীন ভেনেজুয়েলায় মার্কিন হামলার বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করেন ট্রাম্প।
ফ্লোরিডায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের সময় ট্রাম্প সাংবাদিকদের জানান, ভেনেজুয়েলার একটি নৌঘাঁটিতে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। তাঁর দাবি, ওই স্থাপনাটি মাদক পাচারের কাজে ব্যবহৃত হতো। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘যেখানে তারা মাদকবোঝাই নৌকা লোড করে, সেখানে বড় বিস্ফোরণ হয়েছে। আমরা নৌকাগুলোতে হামলা করেছি, এবার সেই এলাকায়ও করেছি। এখন জায়গাটিই আর নেই।’ তবে হামলার বিস্তারিত তথ্য তিনি প্রকাশ করেননি।
নিচে ২০২৫ সালে ট্রাম্প প্রশাসনের সামরিক তৎপরতার বিস্তারিত তুলে ধরা হলো—
সংঘাত পর্যবেক্ষণ সংস্থা এসিএলইডি আল-জাজিরাকে জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ড্রোন ও যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশে ৬২২টি হামলা চালিয়েছে বা তাতে অংশ নিয়েছে। এই হামলাগুলো হয়েছে সাতটি দেশে।
ভেনেজুয়েলা ও ক্যারিবীয় অঞ্চল
ভেনেজুয়েলার ভূখণ্ডে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম স্বীকৃত সামরিক হামলা। সেপ্টেম্বর থেকে ক্যারিবীয় সাগরে ভেনেজুয়েলাসংশ্লিষ্ট নৌযানে হামলা চালিয়ে আসছিল ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এসব নৌযান মাদক পাচারে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, এসব হামলায় এখন পর্যন্ত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। তারা একে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
নাইজেরিয়া
২৫ ডিসেম্বর বড়দিনে উত্তর-পশ্চিম নাইজেরিয়ায় আইএস-সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র বিমান হামলা চালায়। ট্রাম্প ও মার্কিন ডানপন্থীরা নাইজেরিয়ায় খ্রিষ্টান নিপীড়নের অভিযোগ তুললেও দেশটির সরকার তা অস্বীকার করেছে। এই হামলা ছিল নাইজেরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সরাসরি সামরিক অভিযান।
সোমালিয়া
২০২৫ সালে সোমালিয়ায় আল-শাবাব ও আইএসআইএসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার সংখ্যা ১১১ ছাড়িয়েছে—যা আগের তিন প্রশাসনের মোট হামলার চেয়ে বেশি। ফেব্রুয়ারি মাসে মার্কিন নৌবাহিনী সোমালিয়ার মাটিতে ‘ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম বিমান হামলা’ পরিচালনা করে বলে দাবি করেছে। এসব হামলায় বেসামরিক হতাহতের অভিযোগ উঠেছে, যার মধ্যে শিশুদের মৃত্যুও রয়েছে।
সিরিয়া
১৯ ডিসেম্বর জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) আস্তানা লক্ষ্য করে সিরিয়াজুড়ে ব্যাপক বিমান হামলা শুরু করে মার্কিন সামরিক বাহিনী। এই অভিযানে জর্ডানের যুদ্ধবিমানও অংশ নিয়েছিল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘অপারেশন হক-আই স্ট্রাইক’ নামে এই অভিযানে মধ্য সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে আইএসের অবকাঠামো, অস্ত্রাগারসহ একযোগে ৭০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে মার্কিন সামরিক বাহিনী।
হামলায় ফাইটার জেট, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও আর্টিলারি ব্যবহার করে ১০০টির বেশি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী গোলা নিক্ষেপ করা হয়।
এর আগে ১৩ ডিসেম্বর পালমিরায় এক আইএস সদস্যের অতর্কিত হামলায় দুই মার্কিন সেনা ও একজন বেসামরিক দোভাষী নিহত হন। আহত হন আরও তিন সেনা। এক বছর আগে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর এটিই ছিল প্রথম কোনো হামলা, যাতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রাণহানি ঘটে। এরপরই মার্কিন বাহিনী পাল্টা হামলা শুরু করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে ‘প্রতিশোধমূলক হামলা’ বলে ঘোষণা দেন।
ইরান
২০২৫ সালের ২২ জুন মার্কিন বিমান ও নৌবাহিনী ইরানের নাতানজ, ইস্পাহান ও ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান থেকে ‘বাংকার-বাস্টার’ বোমা ফেলে স্থাপনাগুলো ধ্বংসের দাবি করেন ট্রাম্প।
পেন্টাগনের হিসাবে, এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি অন্তত দুই বছর পিছিয়ে গেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল।
ইয়েমেন
লোহিত সাগরে হুতি বিদ্রোহীদের আক্রমণ ঠেকাতে ১৫ মার্চ থেকে ৬ মে পর্যন্ত ‘অপারেশন রাফ রাইডার’ পরিচালনা করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন হামলায় ইয়েমেনের বন্দর, বিমানবন্দর ও রাডার সিস্টেম ধ্বংস করা হয়। মে মাসে ওমানের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হওয়ার আগপর্যন্ত এই অভিযানে কয়েক শ মানুষের মৃত্যু হয়।
হুতি নিয়ন্ত্রিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে এসব হামলায় ১২৩ জন নিহত হন, যাঁদের বেশির ভাগই বেসামরিক।
ইরাক
গত ১৩ মার্চ ইরাকের আল-আনবার প্রদেশে আইএসের শীর্ষ নেতাদের লক্ষ্য করে আকাশপথে হামলা চালায় মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড (সেন্টকম)। এই হামলায় আইএসের উপপ্রধান ও ইরাকের ‘ডেপুটি খলিফা’ হিসেবে পরিচিত আবু খাদিজাহ নিহত হন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একে ‘শান্তির জন্য শক্তি প্রয়োগ’ হিসেবে অভিহিত করেন।
শান্তির প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, তাঁর সাফল্য নির্ধারিত হবে ‘যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে নয়, বরং যুদ্ধ শেষ করার মাধ্যমে’। তবে বাস্তবে তাঁর প্রশাসন আগের দশকগুলোর মতোই সামরিক হস্তক্ষেপের পথে হেঁটেছে এবং আগামী বছরেও এভাবেই চলবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক চিন্তক প্রতিষ্ঠান কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেস্পনসিবল স্টেটসক্র্যাফটের বিশ্লেষক সারাং শিদোরে বলেন, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক হামলাগুলো মূলত ঘরোয়া রাজনীতির চাপ থেকে পরিচালিত প্রতীকী শক্তি প্রদর্শন।
মোটকথা, ট্রাম্প একদিকে ইউক্রেন বা কঙ্গোর মতো যুদ্ধ বন্ধের দাবি করলেও জাতীয় নিরাপত্তা ও মাদক নিয়ন্ত্রণের অজুহাতে আমেরিকা মহাদেশ এবং আফ্রিকায় সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপে জড়িয়ে পড়েছেন। নতুন বছরে এ ধরনের হামলা বন্ধ হবে নাকি আরও বেশি হবে, তা অনিশ্চিত।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করেছেন জগৎপতি বর্মা