হোম > বিশ্লেষণ

ধনীদের চক্করে সিঙ্গাপুর?

মারুফ ইসলাম

সিঙ্গাপুর শুধু পর্যটনের জন্যই স্বর্গ নয়, অতি ধনীদের বসবাসের জন্যও স্বর্গসম। সারা বিশ্ব থেকে দল বেঁধে ধনীরা তরি ভেড়াচ্ছেন সিঙ্গাপুরে এবং এই তরি ভেড়ানোর প্রবণতা গত কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে। তাতে লাভ-ক্ষতি দুই-ই হয়েছে সিঙ্গাপুরের। 

ক্ষতির প্রসঙ্গটা ক্রমশ আসবে, তার আগে লাভের আলোচনাটা করা যাক। সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি যে গত কয়েক দশকে ফুলেফেঁপে উঠেছে, তা তো অজানা নয়। গত বছরই দেশটির অর্থনৈতিক খাত ৭ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। আর অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সিঙ্গাপুরের সামগ্রিক অর্থনীতির চেয়ে এই খাত বেড়েছে ৪ গুণ দ্রুততার সঙ্গে। ফলে এশিয়ার এই নগররাষ্ট্র দিনে দিনে এশিয়ার নেতৃস্থানীয় বৈদেশিক মুদ্রাবাজার হয়ে উঠছে। এসবের পেছনের নটরাজ কে তবে? অবশ্যই বিত্তশালীরা। 

বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কাজ করে এমন একটি লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নাইট ফ্রাঙ্ক বলছে, ২০২৬ সালের মধ্যে সিঙ্গাপুরে অতি ধনীদের সংখ্যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাবে। 

তার কিছু লক্ষণ ইতিমধ্যে সুস্পষ্ট হতে শুরু করেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসায় সিঙ্গাপুর তার সীমান্ত পুনরায় খুলে দিয়েছে। ফলে সিঙ্গাপুরে বিদেশিদের আনাগোনা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে চীনের হংকং ও সাংহাই শহর এখনো করোনা বিধিনিষেধের আওতায় থাকায় এ দুটি শহর থেকেও প্রচুর বিদেশি সিঙ্গাপুরের দিকে পা বাড়িয়েছে। এতে করে এশিয়ার অর্থনৈতিক কেন্দ্র বলে বিবেচিত এই তিন শহরের মধ্যে সিঙ্গাপুর এখন প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। 

যে রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর সিঙ্গাপুরের এই অর্থনৈতিক শিল্প গড়ে উঠেছিল, সেটিও বদলে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে দেশটির ক্ষমতাসীন পিপলস অ্যাকশন পার্টি (পিএপি) ঘোষণা করেছিল যে তাদের নেতা লরেন্স ওং ভবিষ্যতে কোনো এক সময়ে দলের প্রধান হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর স্থলাভিষিক্ত হবেন। এ ঘোষণার প্রায় দুই মাস পর ১৩ জুন তিনি সিঙ্গাপুরের উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। 

১৯৫৯ সাল থেকে সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে পিএপি। দলটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা লরেন্স ওং সিঙ্গাপুরের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে। এর আগে তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। ২৮ জুন তিনি এক বক্তৃতায় বলেছেন, সিঙ্গাপুরের অনেক মানুষ এখন চাকরি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে আছেন, কারণ তাঁদের চাকরির বাজারে বিদেশিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। তিনি এই খাতে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। 

তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশিদের জন্য চাকরির বাজার উন্মুক্ত রেখে দেশীয়দের কর্মসংস্থান করা ওংয়ের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে। 

ছয় দশক ধরে সিঙ্গাপুর শাসন করছে পিএপি। বাণিজ্যিক দিক থেকে নিরপেক্ষতার জন্য দলটির বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। সিঙ্গাপুরে বিরোধী দল নেই এমন নয়। তবে কাদা-ছোড়াছুড়ির পরিবর্তে সুশাসন নিশ্চিতকরণেই তাদের মনোযোগ বেশি। ফলে দেশটিতে যেকোনো ব্যক্তির দক্ষতা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন হয়। আর এসব কারণে ক্রমবর্ধমান অশান্ত এই পৃথিবীতে সিঙ্গাপুর ব্যবসায়ীদের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য ও আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে উঠেছে। 

এটিই সিঙ্গাপুরের অনন্য শক্তি। দেশটির সরকার রাজনীতিকে এমনভাবে কাঠামো দান করেছে যে তা অর্থ-শিল্পের জন্য আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। বিমাসহ অর্থ-শিল্প ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরের জিডিপিতে ১৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবদান রেখেছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য এশিয়ান ব্যাংকারের প্রতিষ্ঠাতা ইমানুয়েল ড্যানিয়েল বলেছেন, এটি সিঙ্গাপুরের অর্থনীতির একটি বড় স্তম্ভ। 

বিদেশিদের জন্য দুয়ার খুলে রেখেছে সিঙ্গাপুর। এ কারণে অস্থায়ী ভিসায় বিদেশি কর্মীদের অনুপাত গত ৫০ বছরে নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। ১৯৭০ সালে এই অনুপাত ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। সেটি ২০২০ সালে হয়েছে ৩৩ শতাংশ। এসব কর্মীর মধ্যে যেমন কম বেতনের গৃহকর্মী আছেন, তেমনি উচ্চবেতনের কর্মকর্তাও আছেন। 

এসব নিয়ে আক্ষেপ আছে সিঙ্গাপুরের স্থানীয়দের মধ্যে। সিঙ্গাপুরের স্থানীয় বাসিন্দা গিলবার্ট গো আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমরা চাকরি পাই না অথবা পেলেও অপেক্ষাকৃত খারাপ চাকরিগুলোই পাই। সব ভালো চাকরি, বেশি বেতনের চাকরি বিদেশিরা দখল করে আছে।’ 

সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ ২০২১ সালে একটি জরিপ চালিয়েছিল। তাতে অংশ নেওয়া অর্ধেক মানুষই জানিয়েছেন, তাঁরা বিদেশিদের কারণে চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। 

সিঙ্গাপুরের এই বাস্তবতা এখন সত্যিই চোখ রাঙাচ্ছে। দক্ষতা কিংবা পেশাদারত্ব—যে কারণেই হোক না কেন, বিদেশি কর্মীরা সিঙ্গাপুরের চাকরির বড় অংশ দখল করে রেখেছেন, সেখানে স্থানীয়দের প্রবেশাধিকার সংকুচিত হচ্ছে। 

সবার জন্য বুক খুলে দিয়ে সিঙ্গাপুর একসময় যে উদারতা দেখিয়েছে, সেই উদারতাই সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের বিনিয়োগকারীদের জড়ো করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং সেই পথ ধরে সিঙ্গাপুর আজকের সমৃদ্ধ সিঙ্গাপুরে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয়দের কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার বাস্তবতাও মেনে নিতে হবে। অস্বীকার করার উপায় আসলে নেই। 

সিঙ্গাপুরে জনগণের আয়-বৈষম্য বাড়ছে। দেশটিতে আয়-বৈষম্য এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের দেশগুলোর চেয়ে বেশি। আয়-বৈষম্য নিয়ে মানুষের ধারণা জানতে ২০২০ সালে একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইপসোস। সমীক্ষায় উঠে এসেছে, সিঙ্গাপুরের প্রতি পাঁচজনের চারজনই বিশ্বাস করেন, দেশটির অর্থনীতি ধনী ও শক্তিশালীদের কবজায় চলে গেছে। 

সিঙ্গাপুর সরকার এই সমস্যাগুলো ঝেঁটিয়ে তাড়াতে চায় বটে। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন পিএপি সর্বকালের সর্বনিম্ন আসন পেয়েছে, যা সরকারকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে। এরই মধ্যে অভিবাসনব্যবস্থা কঠোর এবং নতুন পয়েন্টভিত্তিক ভিসা ব্যবস্থা চালু করেছে পিএপি সরকার। 

এ ছাড়া গত ১৮ এপ্রিল এক নতুন নিয়মের ঘোষণা দিয়েছে সিঙ্গাপুর সরকার। এই নিয়মের আওতায় অতি ধনীরা আর করমুক্ত ব্যবসা চালাতে পারবে না। অতি ধনীদের পারিবারিক ব্যবসাগুলো প্রতিবছর সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিতে ৫ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার থেকে ১০ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার খরচ করতে হবে, যা আগে ছিল ২ লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার। এ ছাড়া স্থানীয় বিনিয়োগের ওপরেও নানা শর্ত আরোপ করেছে সিঙ্গাপুর সরকার। 

এসব ছোটখাটো পরিবর্তনে সিঙ্গাপুরের সমস্যার খোলনলচে পাল্টে যাবে বলে মনে করেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে লরেন্স ওং এখনো আশাবাদী। গত ২৮ জুন তিনি বলেছেন, শুধু গুটি কয়েক মানুষ নয়, বরং সবাই যাতে উপকৃত হয় এমন একটি অর্থনৈতিক সমাজ তিনি গড়ে তুলতে চান। এ জন্য ধনীদের ওপর আরও কর বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন তিনি। কয়েক বছর আগেও সম্পদ করের ধারণা নিষিদ্ধ ছিল সিঙ্গাপুরে, কিন্তু এখন তা আবার আলোচনার টেবিলে নতুন মাত্রা পেয়েছে। 

ওংয়ের এসব সংস্কার উদ্যোগের ওপর আস্থা রাখছেন কেউ কেউ। যেমন হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষক ডোনাল্ড লো বলছেন, ‘ওং একজন রূপান্তরকামী প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। তাঁর নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর আরও সুন্দর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।’ 

তবে ওং কতটা সফল হবেন তা নির্ভর করছে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দাটা তিনি কতটা শক্ত হাতে সামাল দিতে পারবেন তার ওপর। মনে রাখা দরকার, সিঙ্গাপুরের অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে হলে বিদেশি কর্মীদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই তাঁর! 

তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, ওয়াশিংটন পোস্ট ও দ্য বিজনেস টাইমস

‘ভেনেজুয়েলা সংকট’ কীভাবে আন্তর্জাতিক সংঘাতের রূপ নিচ্ছে

ভেনেজুয়েলার তেল আমাদের সম্পদ—ট্রাম্প প্রশাসনের এই দাবি কি যৌক্তিক

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!