হোম > বিশ্লেষণ

বাজফিডের পথে ভাইস: যে কারণে ফেসবুকনির্ভর ডিজিটাল মিডিয়ার দুর্দিন

জাহাঙ্গীর আলম

ফেসবুক ও গুগলের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোর অ্যালগরিদম অনুসরণ করে প্রতিষ্ঠিত বিনামূল্যের সংবাদমাধ্যমগুলোর দুর্দিন শুরু হয়ে গেছে। গত ২০ এপ্রিল বাজফিড নিউজ বিভাগ বন্ধ করে দিয়েছে।

এবার কানাডিয়ান–আমেরিকান ম্যাগাজিন ভাইস ও মাদারবোর্ডের মূল কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রে দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করেছে। মিডিয়াটি গ্রুপটি একটি ঋণদাতা সংস্থার কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে ভাইস মিডিয়া গ্রুপের বাজারমূল্য ছিল ৫৭০ কোটি ডলার। সেটি এখন মাত্র ২২ কোটি ৫০ লাখ ডলারে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।

যেখানে ২০১৬ সাল নাগাদ বাজফিডের বাজারমূল্য ছিল আনুমানিক ১৭০ কোটি ডলার। বর্তমানে বাজফিডের মূল্য নেমে এসেছে ১০ কোটি ডলারে।

ভাইসের যাত্রা শুরু ১৯৯৪ সালে। শেন স্মিথ, গ্যাভিন ম্যাকইনেস এবং সুরুশ আলভির যৌথ উদ্যোগে ‘ভয়েস অব মন্ট্রিল’ নামে একটি প্রথাবিরোধী ম্যাগাজিন হিসেবে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ৩০ টিরও বেশি দেশে তাদের কার্যক্রম রয়েছে।

প্রিন্ট, অনলাইন, ইভেন্ট, মিউজিক, টিভি এবং ফিচার ফিল্ম ও তরুণদের নানা বিষয়ে কনটেন্ট প্রকাশ করে ভাইস। শুরুর দিকে প্রচলিত সব মিডিয়ার চেয়ে ভিন্নধর্মী ছিল সেগুলো। একটি স্বতন্ত্র মিডিয়া হিসেবে দ্রুতই জায়গা করে নিয়েছিল।

 ২০১২ সালে ব্রুকলিনে ভাইসের প্রধান কার্যালয় পরিদর্শনের পর মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডক টুইট করেছিলেন, ‘ভাইস মিডিয়ার কথা কেউ কি শুনেছে? মিলেনিয়ালদের জন্য চটকদার কনটেন্ট তৈরি করে তারা। দ্রুতই বিশ্বব্যাপী সাফল্য পেয়েছে।’ 

এ পর্যন্ত ভাইস যা কিছু অর্জন করেছে তা দু–এক কথায় বলে শেষ করা যাবে না। সংস্থাটির এক সাংবাদিক সিরিয়ায় আইএসআই সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ভিডিও ধারণ করেছিলেন। ওই ভিডিওচিত্রের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মাই জার্নি ইনসাইড ইসলামিক স্টেট’। তাঁরা উত্তর কোরিয়ার ‘ক্রীড়া কূটনীতি’ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করতে বাস্কেটবল তারকা ডেনিস রডম্যান এবং হারলেম গ্লোবেট্রটার্স দলের পেছনে ছায়ার মতো ছুটেছে। 

সম্প্রতি বিতর্কিত ইনফ্লুয়েন্সার অ্যান্ড্রু টেট সম্পর্কে তথ্যচিত্র এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছে ভাইস। 

ভাইস মিডিয়া গ্রুপে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে—ফোর্টেস ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ, মনরো ক্যাপিটাল এবং সোরোস ফান্ড ম্যানেজমেন্ট। শেষোক্ত সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপক বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারী জর্জ সোরোস। 

আশা ছিল, ভাইস ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কগুলোর ওপর ভর করে লাখ লাখ তরুণ পাঠক–দর্শকদের আকৃষ্ট করে ব্যাপক আয় করবে। 

কিন্তু গত কয়েক বছর কোম্পানির আয় একটুও বাড়েনি। তাঁরা লাভের মুখ দেখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনোটাই সফল হয়নি। ভাইসের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলোকে একীভূত করেও সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

ফেসবুক চালু হওয়ার ঠিক দুই বছর পর, ২০০৬ সালে চালু হয় বাজফিড। লিস্টিকেল আর কুইজের মতো কন্টেন্ট দিয়ে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফেসবুকের নিউজফিডে ছিল বাজফিডের আধিপত্য। নিউজ কনটেন্টে বাজফিডই ভবিষ্যৎ হতে যাচ্ছে—এমন উচ্চাশা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। 

 ২০০৮ সালের মহামন্দার পর প্রচলিত গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপনের বাজেট ব্যাপকভাবে কমে গিয়েছিল। ২০১০ সালে আবার বিজ্ঞাপন বাজেট বাড়তে থাকলে বেশিরভাগ চলে যায় ডিজিটাল মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের অর্ধেকটাই তখন ফেসবুক (মেটা) এবং গুগলের নিয়ন্ত্রণে। 

 ২০১৫ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস, বাজফিডসহ অনেক প্রতিষ্ঠান ফেসবুকের ইনস্ট্যান্ট আর্টিকেল ফিচারে কন্টেন্ট প্রকাশ শুরু করে। এভাবে বিজ্ঞাপন থেকে আয়ের ৭০ শতাংশ আসতে থাকে তাদের। ফলে আয়ের দিক থেকে ফেসবুক–গুগলের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এই নিউজ মিডিয়াগুলো।

কিন্তু প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার মুখে থাকা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো তাদের অ্যালগরিদম ও নীতি কৌশল বারবার পরিবর্তন করতে শুরু করে। ইউটিউব এবং পরে টিকটকের মতো ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম এসে ইন্টারনেটের দুনিয়া মাত করতে থাকলে ফেসবুকও ভিডিও কনটেন্টের ওপর জোর দেয়। এতে চাপে পড়ে বাজফিডের মতো মিডিয়া কোম্পানিগুলো। হঠাৎ করে কনটেন্টের পেছনে বাজেট বাড়াতে হয়। অনেক সংবাদ প্রতিষ্ঠানই লেখক আর সম্পাদকদের ছাঁটাই করে নতুন ভিডিও দল তৈরির পেছনে অর্থ ব্যয় করতে থাকে।

কিন্তু ডিজিটাল বিজ্ঞাপনের অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা, বড় প্রযুক্তি পাল্লা দিতে ব্যর্থ হওয়া, আর বিভিন্ন গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট সবার জন্য বিনামূল্যে প্রবেশের সুবিধা দেওয়ার কারণে বাজফিডের মতো মিডিয়া আউটলেটগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে ওঠে। মুষ্টিমেয় কিছু প্ল্যাটফর্মের কাছে নিউজ আউটলেটগুলো যে জিম্মি তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

অ্যান্ডার্স অ্যানালাইসিসের টেকনোলজি প্রধান জোসেফ টিসডেল বিবিসিকে বলেন, ‘ভাইস এবং এর মতো সব ওয়েবসাইটের মূল সমস্যা হলো তারা বিনামূল্যে অনলাইন সাংবাদিকতার কোনো ব্যবসায়িক মডেল তৈরি করেনি।’ 

ভাইসের মতো ওয়েবসাইটগুলো যখন এসেছিল তখন ডটকমের উত্থানের সময়। সেই যুগ আর নেই উল্লেখ করে টিসডেল বলেন, ‘সেই সময়ে সবাই সবকিছুকে সফটওয়্যারের সঙ্গে তুলনা করছিল। যেন এখানে বিনিয়োগ করলেই প্রচুর ব্যবহারকারী এসে পড়বে। দ্রুতই বৃহৎ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে এবং বিপুল লাভজনক হয়ে উঠবে। কিন্তু এসব ভাবনা ভুল ছিল। কনটেন্ট ব্যবসা এভাবে চলে না। যদি চান মানুষ বারবার আপনার ওয়েবসাইটে ফিরে আসুক, তাহলে নতুন বাজারে নতুন মানুষের জন্য নতুন নতুন কনটেন্টের পেছনে আপনাকে বিনিয়োগ করতে হবে।’

টিসডেল বলেন, ‘ভাইস সাংবাদিকতায় কনটেন্ট তৈরি করতে গিয়ে অনেক বেশি খরচ করে ফেলেছে। বিদেশে ভ্রমণে পাঠিয়েছে অনেক প্রতিনিধিকে, এটা ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল।’

এদিকে গত মাসে ভাইস তার ফ্ল্যাগশিপ টিভি প্রোগ্রাম বন্ধের পর কর্মী ছাঁটাইয়ের পথেও হেঁটেছে। বাজফিড নামের আরেকটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সম্প্রতি নিউজ বিভাগ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটি এরই মধ্যে অর্থসংকট ও বিজ্ঞাপনের রাজস্ব কমে যাওয়ার পর ১৫ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করছে। 

ভাইস মিডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১১ ধারায় দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করেছে। এই প্রক্রিয়া শুরু হলে ঋণদাতাদের কাছে তাদের দায় স্থগিত হবে, পাশাপাশি ঋণ পুনর্গঠন বা কিছু সম্পদ বিক্রি করার সুযোগ পাবে তারা। অবশ্য এই প্রক্রিয়া শেষ হতে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগতে পারে। 

প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকার প্রয়াসে বারবার অ্যালগিরদম পরিবর্তন ফেসবুকের নিউজ ফিডের কল্যাণে বড় হওয়া বাজফিডের মতো প্রকাশনাগুলোকে খুবই নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছে।

টিকটকের বর্তমান ব্যবহারকারী ১৬০ কোটি, যেখানে মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারী ১০৫ কোটি। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণের পরও অপ্রতিরোধ্য এই সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবের মতো প্রতিষ্ঠানকেও শর্ট ভিডিওর দিকে নজর দিতে বাধ্য করেছে। ফেসবুকের রিল এবং ইউটিউবের শর্টস এখন টিকটকের ফিচার নকল করছে! বৃহৎ ওয়েব প্ল্যাটফর্মগুলোর এই প্রবণতা ডিজিটাল (নিউজ পোর্টাল) ও প্রচলিত (প্রিন্ট) উভয় মাধ্যমকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলে পুরোনো প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলো ক্রমেই সাবস্ক্রিপশন ভিত্তিক সেবার দিকেই ঝুঁকছে। ফেসবুক বা ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের ওপর নির্ভরশীল ডিজিটাল প্রকাশকদের জন্য সামনের দিনগুলো নিঃসন্দেহে আরও কঠিন হবে।

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

কোন দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বাধিক, বাংলাদেশের চিত্র কেমন

যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা দক্ষ ইতালির জঙ্গি বিমান ইউরোফাইটার টাইফুন

থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত থামেনি, ট্রাম্প ‘থামিয়েছেন’ দাবি করা অন্য যুদ্ধগুলোর কী অবস্থা