ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ অজানা। কখন, কীভাবে শেষ হবে এ যুদ্ধ—কেউ জানে না। তবে একটা বিষয় সবাই জেনে গেছেন। সেটি হচ্ছে, পুতিন কখনোই কিয়েভে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। এমনকি তিনি দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে দখল করা অঞ্চলগুলোর ক্রমশ হাতছাড়া হওয়াও ঠেকাতে পারবেন বলে মনে হয় না।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ অভিযান’ নাম দিয়ে ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বছর ঘুরে এসেছে, ৩৬৫ দিনের বেশি সময়ে রাশিয়ার অর্জন কী? যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখল করেছিল রাশিয়া, সেসব অঞ্চল বছর শেষে একটু একটু করে ছেড়ে দিতে হয়েছে। পিছু হটতে হয়েছে রুশ বাহিনীকে। দীর্ঘ এক বছরেও রাজধানী কিয়েভ দখল করতে পারেনি রাশিয়া। বেশ কয়েকবার কিয়েভের দিকে অগ্রসর হয়েও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন বাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটতে হয়েছে।
বিস্ময়কর সত্য হচ্ছে, ২০২২ সালের আগ্রাসন শুরুর আগে তিনি ইউক্রেনের যে অঞ্চলগুলো দখল করেছিলেন, সেগুলো এখন ধরে রাখা তাঁর পক্ষে বিস্তর কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের যেসব অঞ্চল দখল করেছিল রাশিয়া, সেসব অঞ্চলও এখন বেহাত হওয়ার পথে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বারবার স্পষ্টভাবে হুমকি দিচ্ছেন এই বলে—রুশদের দখল করা সব অঞ্চল পুনরুদ্ধার করা হবে।
এখানে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. ক্রিমিয়ার ভাগ্য কী হবে (২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করেছেন পুতিন)। দুই. ক্রিমিয়া জয়ের পর রাশিয়ার যে গতি এসেছিল, তার কী হবে। তিন. রাশিয়ার পশ্চিমা নীতিই বা কী হবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্রিমিয়া হাতছাড়া হয়ে গেলে পুতিনের মসনদই নড়বড়ে হয়ে উঠতে পারে। যে নেতা ক্রিমিয়াকে ধরে রাখতে পারেন না, তিনি ক্রেমলিনকে কীভাবে ধরে রাখবেন? পুতিন তাঁর এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতির কথা জানেন বলেই ধরে নেওয়া যায়।
তবে একজন দ্বিধাগ্রস্ত নেতা হিসেবে পুতিনের কুখ্যাতি রয়েছে। তিনি সহজে ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ইউক্রেনীয় বাহিনী সরাসরি ক্রিমিয়ায় আক্রমণ করতে পারে, ক্রিমিয়ার সঙ্গে সংযোগ সেতু ধ্বংস করে দিতে পারে—এসব আতঙ্ক পুতিনের মনে আছে। সে ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেবেন বা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবেন, তা নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আছেন পুতিন।
আর একটি ব্যাপার নিঃসন্দেহেই বলা যায়, রুশ বাহিনী এই যুদ্ধ পরাজিত হলে রাশিয়াজুড়ে পুতিনবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হবে। তিনি জনগণের কাছে অবিমৃশ্যকারী, হঠকারী ও বুদ্ধিহীন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। তখন সেই বিক্ষোভ কীভাবে সামাল দেওয়া হবে, সেটিও রুশ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের ভাবিয়ে তুলছে।
অবশ্য ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরুর পর পরই রাশিয়ার অনেক শহরে পুতিনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। যারা যুদ্ধের বিরুদ্ধে, তারাই মূলত বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে; আটক ও গ্রেপ্তারের ঘটনাও ঘটেছে। গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ পর্যবেক্ষণকারী রাশিয়ান গ্রুপ ওভিডি-ইনফো জানিয়েছে, রাশিয়াজুড়ে ৩৮টি শহরে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ৩১১ জনকে আটক করার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে মস্কো থেকে ৫০২ জন এবং সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে ৫২৪ জনকে আটক করা হয়েছে।
সে যাই হোক। পুরো ইউরোপকে রাশিয়া নিরাপত্তা দিতে পারে, এমন একটি উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল পুতিনের। সেই উচ্চাকাঙ্ক্ষা ক্রমশ ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে। রাশিয়া যদি হেরে যায় এ যুদ্ধে, তবে দোষ চাপানো হবে অদক্ষ ও অযোগ্য জেনারেলদের ওপর। বলা হবে, রাশিয়া জয়ী হতেই পারত, শুধু জেনারেলদের অযোগ্যতার কারণেই তা সম্ভব হয়নি।
ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পর এটি মোটামুটি স্পষ্ট যে, সামনের দিনগুলোতে শাসনক্ষমতা প্রলম্বিত করাই এখন পুতিনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। শেষ পর্যন্ত রুশ জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে, তিনি আর কত দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবেন।
সূত্র: দ্য ইনডিপেনডেন্ট, বিবিসি, দ্য গার্ডিয়ান, রয়টার্স ও আল জাজিরা