কাশফিয়া আলম ঝিলিক, ঢাকা
বাতাসে বহিছে প্রেম,
নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে!
বসন্ত এসে গেছে…
শাহবাগ মোড়ের কোনো কোনো দোকানে লগ্নজিতার কণ্ঠে বাজতে শুরু করেছে এ গান। মোড়ের বৃক্ষগুলোতে কচি পাতার আভাস, বইমেলার কোলাহল আর ফুলের দোকান দেখলেই মনে পড়ে বসন্ত এসে গেছে।
তবে এটা ঠিক, শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে কোনটা বসন্তবেলা আর কোনটা শেষ মাঘের বিকেল, সেটা ঠাহর করা একটু কঠিন বৈকি। এখানে সারা বছরই ফুলের দেখা পাওয়া যায় যে! তবে রাবেয়ার ভুল হয় না। ২৫ বছরের অভিজ্ঞতা বলে কথা! শাহবাগ মোড়ের সারি সারি ফুলের দোকানের একটির মালিক রাবেয়া। ২৫ বছর ধরে ভোর পাঁচটা থেকে দোকান সাজানোর অভ্যাস তাঁর।
এই আসি আসি করে না-আসা বসন্তের এক ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। রজনীগন্ধার মালা গাঁথতে গাঁথতে রাবেয়া বলেন, ‘আগের তুলনায় মানুষ এখন ফুল বেশি চিনে, বুঝে। তখন আমাদের খুব কষ্ট হইত ব্যবসা করতে। তবু আমরা বিভিন্ন ধরনের ফুল আনতাম, বিক্রি করার চেষ্টা করতাম।’
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ বদলেছে। বদলেছে তাদের আচার-আচরণ। সংস্কৃতিও বদলেছে অনেকটাই। সেই রজনীগন্ধার মালা হাতে ধরে রাবেয়া জানান, এখন ফুল বেচাকেনা এবং এর ব্যবহার বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাবেয়াও অনেক ধরনের ফুল চিনেছেন এবং সেগুলো বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতে শিখেছেন। তিনি নিজে থেকেই দোকানের ফুল দিয়ে প্রায় ৬ লাখ টাকার ব্যবসা করছেন বলে জানান।
কীভাবে গ্রাহকের কাছে ফুল নতুনভাবে তুলে ধরবেন, তাদের আগ্রহ ফুলের দিকে আরও বাড়িয়ে তুলবেন এমন প্রশিক্ষণেও অংশগ্রহণ করেছেন রাবেয়া। সারা দিন দোকানে বসে বেচাকেনার পাশাপাশি ফুল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মালা নিজের হাতেই তৈরি করেন তিনি। রাবেয়া মনে করেন, বিদেশি কিছু ফুলের চাহিদা আছে দেশে। সেই ফুলগুলো চাষ হলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই খুশি হবেন।
একসঙ্গে আটজন নারী এখানে ফুলের দোকান নিয়ে বসেন। অনেকে নিজেই এখনো দোকান চালান, অনেকের ছেলেরা এখন বসেন সেই দোকানে। রাবেয়ারা অনেক আগে থেকে এখানে কাজ করেন বলে সবাই তাঁদের সম্মান করে। ফুলের লট এলে তাঁরা সেখান থেকে বেছে নেওয়ার সুযোগও পান। ২৫ বছরের কর্মজীবন কেমন কাটল রাবেয়ার? আর সবার মতো তিনিও এ প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা দার্শনিক হয়ে ওঠেন। বলেন, ‘জীবন তো পারই কইরা দিলাম এই কাজ কইরা। জমিজমা, বাড়ির কোনো আশা আমি করি না। ছেলেমেয়ে বড় হইছে, নিজে খেয়েপরে বাঁচি, এটাই অনেক। তবু মনে হয়, যদি একটা ভালো জায়গা কইরা দেওয়া হইত দোকান করার জন্য, তাহলে শেষ দিনগুলা আর একটু ভালো হইত। এই ফুলটা এখান থেকে সব মানুষের হাতে চইলা যায়; কিন্তু আমরাই শুধু ফুটপাতে বইসা থাইকা এই ফুল বিক্রি করি।’
আমি ভাবি, শাহবাগের এই মানুষের সাগরে বসে রাবেয়া কী স্বপ্ন দেখেন? ‘দোকান বন্ধ কইরা একলগে বাড়ি’ যাওয়ার? সে যাহোক, রাবেয়া রজনীগন্ধার মালা গাঁথেন। তাতে লাল টকটকে গোলাপ জুড়ে দিয়ে পেনডেন্ট বানান। জীবন আর যাপন যখন অদ্ভুত আঁধারে খাবি খেতে খেতে এগিয়ে চলে, রাবেয়া তখন ফুলের লট থেকে ফুল বেছে নেন। স্বামী, সংসার, সন্তান কেউ যেন তাঁকে ঠিক ছুঁতে পারে না। ফুল বাছার সে আনন্দ আর স্বাধীনতা শুধুই রাবেয়ার। সেখানে তিনিই রানি। তিনিই সম্রাজ্ঞী।
আমরা কথা শেষ করি। সামনে বইমেলা। সেদিকে পা বাড়াই। তখন হয়তো রাবেয়া তাঁর স্বামীর সঙ্গে ফুলের ব্যবসা ৬ লাখ থেকে ৮ লাখে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছেন। অথবা ভাবছেন, আগামীকাল যে ফুল আসবে, সেখান থেকে তাজা গোলাপগুলো তিনিই তুলে আনবেন!
রাবেয়ার দোকানে যেসব ফুল পাওয়া যায়
চন্দ্রমল্লিকা, ক্যাপ গোলাপ, চায়নিজ গোলাপ, দেশি গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, গাঁদা।