যুক্তরাষ্ট্রে নারীরা যখন ভোটাধিকারই পাননি, তখন দেশটির ফেডারেল কংগ্রেস সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন জ্যানেট র্যাঙ্কিন। নারীদের ভোটাধিকার, কর্মক্ষেত্রে যোগদান বিষয়ে নারী-পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও শিশু অধিকার বিষয়ে অগ্রনায়কের ভূমিকা তাঁকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। বেঁচে থাকলে আজ জ্যানেটের বয়স হতো ১৪১ বছর।
যুক্তরাষ্ট্রের মনটানা অঙ্গরাজ্যে ১৮৮০ সালের ১১ জুন র্যাঙ্কিনের জন্ম। বড় চিন্তার বুনিয়াদি শিক্ষাটা পরিবার থেকেই পেয়েছেন। শিক্ষাজীবনে ইউনিভার্সিটি অব মনটানা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ভর্তি হন নিউইয়র্ক স্কুল অব ফিলানথ্রপিতে। পড়াশোনা শেষ করে সমাজকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে জন্মস্থানের নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে থেকে ১৯১৪ সালে ফিরে আসেন মনটানায়। নেতৃত্বগুণে ওই বছরই তিনি জায়গা করে নেন দেশের রাজনৈতিক দল প্রোগ্রেসিভ রিপাবলিকানে।
জ্যানেটের নেওয়া নানা উদ্যোগে মনটানার রাজনীতিতে নতুন গতি আসে। এরই ধারাবাহিকতায় মনটানায় কংগ্রেসের দুটি আসনের একটিতে রিপাবলিকান পার্টি থেকে মনোনয়ন পান র্যাঙ্কিন। ১৯১৬ সালের কংগ্রেস নির্বাচনে তিনি সর্বস্তরের নারী-পুরুষের সমর্থনে বিপুল ব্যবধানে জয় পান। এরই মধ্যদিয়ে সৃষ্টি হয় যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ইতিহাস, মার্কিন ফেডারেল কংগ্রেসে প্রথবারের মতো জায়গা করে নেন এক নারী। নির্বাচিত হয়ে বলেন, ‘কংগ্রেসে আমি প্রথম নারী হতে পারি; তবে শেষ নারী হতে চাই না।’
বিচক্ষণতা ও কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন জ্যানেট র্যাঙ্কিন। আজীবন শান্তিকামী এই নেত্রী মনে-মগজে বিশ্বাস করতেন, নারীদের হাতে বেশি ক্ষমতা থাকলে যুদ্ধ আরও অনেক কম হতো। র্যাঙ্কিনের কাজেও পড়েছে এ বিশ্বাসের প্রভাব। নির্বাচিত প্রথম নারী কংগ্রেস হিসেবে র্যাঙ্কিন যেদিন শপথ নেন, সেদিনই প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন কংগ্রেসের কাছে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অনুমোদন চান। কংগ্রেসে ৩৭৩-৫০ ব্যবধানে এ প্রস্তাব পাস হলেও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য নৈতিকতার সঙ্গে আপোষ করেননি র্যাঙ্কিন। কংগ্রেস সদস্য হিসেবে পাওয়া প্রথম ভোটাধিকারটি প্রয়োগ করেছেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যোগ দেওয়ার বিপক্ষে। এ জন্য তাঁকে অবশ্য চড়া রাজনৈতিক মূল্য দিতে হয়েছে। সেদিন হেলেনার স্থানীয় একটি সংবাদপত্র তাঁকে, ‘কাইজারের এক পয়সা’, ‘হুন সেনাবাহিনীর সদস্য’, ‘ছিচকাঁদুনে স্কুলছাত্রী’ বলে উল্লেখ করে। ২০১৮ সালে কংগ্রেসে পুনর্নির্বাচিত না হওয়ার পেছনেও এই ঘটনা ভূমিকা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
২০১৮ সালে কংগ্রেস নির্বাচনে পরাজয়ের পর ২০ বছর জ্যানেট শান্তির বাণী প্রচার, নারী অধিকার, শিশু অধিকার, শিশুশ্রম ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করেন। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৪০ সালে এসে তিনি আবার হাউজ অব রিপ্রেজেন্টিটিভ নির্বাচিত হন। এ দফায় যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। তবে র্যাঙ্কিনের অবস্থান আগের মতোই, যুদ্ধে যোগদানের বিপক্ষে।
তবে এদিন ভোটের পরে ক্যাপিটল ভবন ছাড়ার সময় একদল ক্ষুব্ধ জনতা তাঁর পিছু নেয়। নিরাপত্তার স্বার্থে র্যাঙ্কিন একটি টেলিফোনের বুথে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। পরে ক্যাপিটল পুলিশ তাঁকে বুথ থেকে উদ্ধার করে। এর দু’দিন পর জার্মানি এবং ইতালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রস্তাবে ভোটের আয়োজন করা হলে র্যাঙ্কিন ভোট বর্জন করেন। এই দফায় জ্যানেট সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব সম্পন্ন করলেও বুঝতে পারেন ভবিষ্যতে জয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই শারীরিক সক্ষমতা থাকলেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৯৪২ সালে তিনি অবসর নেন।
৯৩ তম জন্মদিনের অল্প কয়েকদিন আগে (১৮ মে,১৯৭৩) র্যাঙ্কিন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ দিন মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, চূড়ান্ত অসুস্থতার আগে পর্যন্ত, তাঁর হাতের ছড়ি আর চোখে চশমা দেখে শুধু মনে হয়েছে যে, তাঁর বয়স হয়েছে। আর সাত দশক ধরে তিনি যে ধারণাগুলোর সমর্থন এবং চর্চা করেছেন তা যেন সততই নবীন হয়ে ধরা দিয়েছে!