সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি তুলে ধরার এই যুগে, প্রেম বা দাম্পত্য সম্পর্ককে প্রকাশ্যে আনা বা ‘হার্ড-লঞ্চ’ করার ক্ষেত্রে দ্বিধা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণী ও নারীদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেক বেশি। পশ্চিমা দেশগুলোতে এই প্রবণতা এখন এতটাই প্রবল যে, ব্রিটিশ ভোগ ম্যাগাজিনও প্রশ্ন তুলেছে, ‘প্রেমিক থাকা কি এখন লজ্জার ব্যাপার?’
ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে এখন অনেকেই সঙ্গীর মুখ আড়াল করে ছবি দিচ্ছেন, শুধু হাত বা পানীয়ের গ্লাস ঠোকাঠুকির মতো ইঙ্গিতপূর্ণ ‘সফট লঞ্চ’ করছেন। এর পেছনে রয়েছে ব্র্যান্ডিং, আত্মনির্ভরতার বার্তা দেওয়া এবং ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তা রক্ষার মতো একাধিক কারণ। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে দৃষ্টান্ত হিসেবে ইনফ্লুয়েন্সার তাওয়ানা মুসভাবুরির কথা উল্লেখ করেছে বিবিসি। তাওয়ানার ৩৩ হাজার ফলোয়ার রয়েছে। তিনি ইচ্ছা করে প্রেমিকের চেহারা আড়াল করে রাখেন। ২৪ বছর বয়সী এই তরুণী বলেন, তিনি এমন একটি ব্র্যান্ড তৈরি করেছেন যেখানে তাঁর প্রেমিকের কোনো অংশ নেই।
তিনি বিবিসি নিউজকে বলেন, ‘আমি নিজেকে একজন শক্তিশালী নারী হিসেবে তুলে ধরতে চাই, যেন মনে হয় আমার সবটা আমার নিয়ন্ত্রণে। আপনি চান না যে, লোকজনের মনে হোক যে এটি কোনো অংশ একজন পুরুষের সহায়তায় গড়ে উঠেছে। যখন আমি বলি, আমি এটি নিজেই করেছি, তখন সেটা আমাকে আরও বেশি তৃপ্তি দেয়।’
তাওয়ানার মতে, এমনকি যদি তিনি বাগদান বা বিয়েও করেন, তাহলেও সেই সম্পর্ক প্রকাশ্যে আনার জন্য শুধু একটি আংটিই যথেষ্ট নয়।
ভোগ ম্যাগাজিনের ভাইরাল হওয়া নিবন্ধে লেখক শঁতে জোসেফ উল্লেখ করেন, বিষমকামী নারীরা এখন তাঁদের সম্পর্ক অনলাইনে যেভাবে তুলে ধরছেন, তাতে একটি বড়সড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নারীরা এখন সঙ্গী থাকার ‘সামাজিক সুবিধা’ উপভোগ করতে চাইলেও, একই সঙ্গে ‘বয়ফ্রেন্ড-পাগল’ হিসেবে পরিচিত হতে চান না।
জোসেফের মতে, ঘন ঘন সঙ্গীর ছবি পোস্ট করাকে অনেকে ‘বিরক্তিকর’ বা ‘সাংস্কৃতিক দিক থেকে ব্যর্থতার লক্ষণ’ বলে মনে করেন। আরও গুরুতর যে বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন সেটি হলো, প্রেমিক থাকা এখন আর ‘কোনো অর্জন’ হিসেবে বিবেচিত হয় না। তিনি মনে করেন, নারীরা এখন পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ‘দমিয়ে রাখার’ প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সম্পর্ক আড়াল করছেন।
ইনফ্লুয়েন্সারদের ক্ষেত্রে এটি কেবল সামাজিক ধারণা নয়, বরং উপার্জনের প্রশ্নও বটে। দক্ষিণ লন্ডনের কনটেন্ট ক্রিয়েটর স্টেফানি ইয়েবোয়াহ ভোগ ম্যাগাজিনকে জানান, একবার তাঁর প্রেমিকের ছবি পোস্ট করার পর তাঁর খুব অনুশোচনা হয়েছে।
তিনি বিবিসিকে বলেন, তাঁর ইনবক্সে বার্তা আসতে শুরু করে যে লোকেরা তাঁকে আর অনুসরণ করতে পারছে না। কারণ তাঁর কনটেন্টে এখন প্রেমিক যুক্ত হয়ে গেছেন। ইয়েবোয়াহ স্মরণ করেন, ‘সেই দিন প্রায় ১ হাজার মানুষ আমাকে আনফলো করেছিল।’
কিং’স কলেজ লন্ডনের ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ ড. জিলিয়ান ব্রুকস বলেন, ইনফ্লুয়েন্সাররা একটি স্বতন্ত্র রুচি বা নান্দনিকতা বিক্রি করেন। তাঁদের দর্শকদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়। যদি তাঁরা সেই ব্র্যান্ডের বাইরে চলে যান, তবে শ্রোতাদের বিভ্রান্ত করেন এবং এতে তাঁদের ফলোয়ার কমে যেতে পারে।
যারা ইনফ্লুয়েন্সার নন, তাঁদেরও সম্পর্ক আড়াল করার নিজস্ব অনেক কারণ আছে। যেমন: নির্ভরশীলতা এড়ানো—মিল্লি নামের ২৫ বছর বয়সী এক তরুণী বলেন, তিনি তাঁর বাগদত্তের ছবি দিতে দ্বিধা বোধ করেন। তিনি চান না যে তাঁকে সঙ্গীর ওপর ‘নির্ভরশীল’ বা এমন কেউ বলে মনে করা হোক যার ‘পুরো ব্যক্তিত্ব’টাই এই সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল।
গোপনীয়তা রক্ষাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ২০ বছর বয়সী শার্লট বিশ্বাস করেন, বন্ধুত্ব থেকে সম্পর্ককে ‘আরও বেশি ব্যক্তিগত’ রাখা উচিত। তিনি মনে করেন, ছবি পোস্ট করা মানেই লোককে বলা, ‘দেখো আমার কত গভীর নিখুঁত সম্পর্ক’—বাস্তবে এটি সত্য নয়।
কু-নজরের ভয়! প্রথম পাঠে খটকা লাগলেও অনেকে ক্ষেত্রে এটি সত্য। ২১ বছর বয়সী আথেরা জানান, তাঁর অনেক বন্ধু সম্পর্কের গোপনীয়তা রাখতে চান কু-নজর বা ‘ইভিল আই’-এর ভয়ে। প্রায় সব সংস্কৃতিতেই কু-নজর বলতে এমন একটি বিশ্বাস বা সংস্কার যে, ঈর্ষা বা বিদ্বেষপূর্ণ দৃষ্টির পড়লে ক্ষতি হতে পারে।
মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির সমাজ মনোবিজ্ঞানী ড. গোয়েনডোলিন সাইডম্যান মনে করেন, ব্যক্তিগত জীবনের এত বড় অংশ অনলাইনে শেয়ার করার সঙ্গে এক ধরনের উদ্বেগ জড়িত। এই উদ্বেগ মূলত অনলাইনে তথ্যের স্থায়িত্বের ভয় থেকে আসে। মানুষ এখন বুঝতে পেরেছে যে একবার কিছু অনলাইনে পোস্ট হলে তা মুছে ফেলা কঠিন। তাই তারা এখন আরও সতর্ক থাকতে চাচ্ছে।