হোম > মতামত > সম্পাদকীয়

দোষারোপের সংস্কৃতি: মুক্তি কি মিলবে

স্বপ্না রেজা

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে এখন নানান কথা, নানান প্রচারণা, নানান সংশয় ও ধারণা চলছে। আর সবটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যে যেমনটা পারছে, যার বুদ্ধিতে যেমনটা কুলাচ্ছে, সে তেমনভাবেই রাজনীতি নিয়ে মত প্রকাশ করছে এবং নিজেকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে জাহির করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছে। কার্যক্রম নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং আপাতত কর্মসূচিহীনভাবে সক্রিয় জাতীয় পার্টি ছাড়া নতুন ও পুরোনো দলগুলো নির্বাচনকেন্দ্রিক তৎপরতা নিয়ে। নির্বাচন নিয়ে এখন ঘুম হারাম অবস্থা বলা যায়। কথা হচ্ছে, ইসির নিরপেক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে। নির্বাচনের উপযুক্ত সময় নিয়েও শুরু হয়েছে বাগ্‌বিতণ্ডা। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে আরেকটু সময় চায়। বিএনপি দেরি করতে নারাজ। তাদের মতে, নির্বাচন হওয়া জরুরি দেশের স্বার্থে। বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষার অন্যতম ও একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন। অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি সংস্কার, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন এবং জুলাই আন্দোলনের সময়কার অপরাধীদের বিচার চায় নির্বাচনের আগে। সংস্কারের আগে নির্বাচন নয়, এমন অবস্থানে থেকেও শেষ অবধি নির্বাচনে তারা অংশগ্রহণ করবে বলে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। এমনকি নির্বাচনের প্রতীক নিয়েও তাদের আর কোনো অভিযোগ নেই। এতে পরিষ্কার হয়েছে যে রাষ্ট্রক্ষমতা সবাইকে শেষ অবধি টেনে নেয়, অনেকটা চুম্বকের মতো।

কোন রাজনৈতিক দলকে ভোট দেওয়া দরকার কিংবা দিতে হবে, রাজনৈতিক অঙ্গনে সেসব নিয়ে বেশ শোরগোল। কোন দলকে ভোট দিলে কী কী সুবিধা জনগণ পাবে, তারও লম্বা ফিরিস্তি-অঙ্গীকার আকাশে-বাতাসে ভাসতে শুরু করেছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় যে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান নেতা বলেছেন, তাঁদের পার্টি নির্বাচনে জয়ী হলে তাঁরা কর্মজীবী নারীদের কর্মঘণ্টা ৫ করবেন, যেন নারীরা তাঁদের সন্তান লালন-পালন করতে পারেন। তিনি আরও বলেছেন, নারীরা ঘরে থাকলে তাঁদেরকে সরকার সম্মানিত করবে। যে দেশে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক, এমনকি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য এবং দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে নারীদের অংশগ্রহণ সম্মানের সঙ্গে স্বীকৃতি পেয়েছে, সেই মুহূর্তে অনেকে মনে করছেন, এ কথার মধ্য দিয়ে আসলে নারীদের পেছনে টেনে নেওয়া হচ্ছে। এ নিয়ে কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সংশয় ও আলাপচারিতা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। নির্বাচন প্রসঙ্গে বা নির্বাচনে জয়লাভ করতে সেই পার্টির নেতাদের হঠাৎ করে নারীদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ অনেকের জন্য বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে বৈকি।

আমাদের অনেকেরই জানা থাকা দরকার যে বর্তমানে দেশে নারী ভোটারের সংখ্যা কম নয় কিন্তু। যেকোনো দলকে নির্বাচনে জয়ী হতে হলে নারীর সমর্থনের দরকার আছে। মানে তাঁদের ভোট লাগবেই। যদিও কেউ কেউ নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী অধিকারের বিরোধিতা প্রায়ই করে থাকে, করতে পিছপা হয় না। এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার যে নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিটি রাজনৈতিক দলই নানান অঙ্গীকারের কথা বলে, কেউ কেউ মানবিক হওয়ার ভান করে, এমনকি সাচ্চা দেশপ্রেমিকও হয়। অনেকে ভাবে এসব হচ্ছে এদের অভিনয়, জাতির সঙ্গে প্রতারণা করার কৌশলমাত্র। তাই জনগণের মধ্য থেকে নির্বাচনে কেউ তার সমুচিত জবাব দেয়, কেউ জবাব দেয় না। বরং স্বার্থবাদী হয়ে আত্মপ্রকাশ করে।

যাই হোক, ভোট চাইতে কোথাও কোথাও পোস্টার ঝুলেছে। শহর, গ্রাম সর্বত্রই নির্বাচনী প্রচারণা। জনগণ ভাবছে, কাকে ভোট দেওয়া যায়, কাকে ভোট দিলে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে, অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। একজন প্রবীণ নারীর কাছে জানতে চাওয়া হলো, ‘ভোট কাকে দেবেন বলে ভাবছেন?’ তিনি জবাব দিলেন, ‘ভোট দিমু না!’

আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির ভোট কারা পাবে, সেটা নিয়েও নির্বাচনের বাজার গরম। বর্তমানে বিএনপির কথাবার্তায় কেউ কেউ ভাবছে, তারাই চেষ্টা করবে এই ভোট ঘরে তুলতে। কারণ, আওয়ামী সমর্থক ও ভোটাররা কখনোই ইসলামি একটি দলকে ভোট দিতে চাইবেন না। এদিকে নতুন দল হিসেবে এনসিপির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনো কিছু বলার সময় আসেনি। জনসংযোগ তাদের সভাকেন্দ্রিক, যেটা জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার একমাত্র উপায় হতে পারে না। আর একটা বিষয়, বিগত সরকার নিয়ে তাদের যতটা বিষোদগার, তার বিন্দুমাত্র নিজেদের রাজনীতি নিয়ে কথা নেই বলে অনেকে মনে করেন।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতার শিকার বারবার সাধারণ মানুষ হয়েছে। ক্ষতির পাশাপাশি আরও যেটা হয়েছে, সাধারণ মানুষ তার লাভ-ক্ষতি হিসাব করতে শিখেছে। ফলে জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার আগ্রহ কমেছে। ফলে ভোটার সংখ্যা অনুযায়ী কম পড়েছে ভোট। সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন, পরিমার্জন ছাড়াই ভোট হতে যাচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে। রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আস্থার জায়গায় পৌঁছাতে পারেনি। তাদের আচরণে দখলদারত্ব, প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা। যেটা সব সময় হয়ে আসছে।

মানুষ যখন ভাবছে, আদৌ নির্বাচন হবে কি না বা কাকে ভোট দেবে, ঠিক তেমন একটা সময়ে বাংলাদেশের একজন নারী বিশ্বমঞ্চ থেকে তাঁকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করে চলেছেন। তানজিয়া জামান মিথিলা, তিনি মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ইতিমধ্যে পাবলিক চয়েসে দ্বিতীয় পজিশনে গেছেন। এই প্রথম কোনো বাংলাদেশি নারীর এমন সাফল্য। তাঁর প্রতিটি স্টেপে বাংলাদেশের নাম যায় সঙ্গে। বাংলাদেশ নামটা উচ্চারিত হয়। দেখলাম, মিথিলা ভোট চাইছেন জয়ী হতে। তাঁর বিষয়ে বাংলাদেশের অনেক নারী-পুরুষকেও সক্রিয় হতে দেখা গেল। তাঁরাও মিথিলাকে মিস ইউনিভার্স হওয়ার জন্য সবার কাছে ভোট চাইলেন। এমন ওপেন ভোট চাওয়ার বিষয়টা কিন্তু রাজনৈতিক তথা জাতীয় নির্বাচনে সাধারণত দেখা যায় না। আরও একটা বিষয়, বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একজন নারী মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ের মুকুট পরবে, সেটাও তো ভাবা যায় না। এই দেশে এখন নারীর পোশাক নিয়ে কথা হয়। আচরণবিধি নিয়ে যখন-তখন যা ইচ্ছা তা-ই বলা হয়। বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গানের শিক্ষক নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্তটাও কিন্তু বলে দেয় যে দেশটাকে কোথায় নিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা চলছে। একটা গোষ্ঠী কর্তৃক নারীর পোশাক ও তাঁর অবস্থানকে নির্বাচন, নির্ধারণ করবার মুহূর্তে একজন মিথিলার মিস ইউনিভার্স হওয়ার ইচ্ছেটা, প্রতিযোগিতায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, তাঁকে বিজয়ী করার জন্য অনেকের ভোট চাওয়া ও ভোট দেওয়ার বিষয়টি কিন্তু জনগণের চেতনার প্রতিফলন ঘটায়। বুঝতে হয়, সাধারণ মানুষ আসলে কী চায়, কী আশা করে।

মিথিলা মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতায় বিপুল ভোট পেয়েছেন বাংলাদেশ থেকে এবং তাঁকে ভোট দেওয়ার আহ্বান কিন্তু একজন নারীর চেয়ে বরং দেশকে সমর্থন করে বেশি এবং এটাই সত্য। এখানে বিষয়টি দৃশ্যমান হয়েছে মিথিলার সৌন্দর্য ও আত্মবিশ্বাসের ওপর। জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়া নয়, কিছুটা সময় মিথিলাকে ভোট দেওয়ার বিষয়ে সবাই যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে! এখনো ব্যস্ত সবাই মিথিলাকে নিয়ে। মিথিলা এক আত্মবিশ্বাসের নাম।

বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা কার হাতে তুলে দেওয়া প্রয়োজন, সেটা জনগণকেই ঠিক করে নিতে হবে এবং সেটা সতর্কতার সঙ্গে। দেশ কতটা এগিয়েছে বা এগোতে হবে, সেই সব বিশ্লেষণ যতক্ষণ পর্যন্ত না দোষারোপের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত হতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আসলে পরিবর্তন হবে না। কোনো রাজনৈতিক দল নয়, বরং জনগণই নির্ধারণ করবে দেশের জন্য প্রকৃত অর্থে কী প্রয়োজন। আর সেই কারণে তারাই ঠিক করবে কাকে ভোট দেবে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

শিক্ষকের ক্ষমতা

ধরা হোক হামলাকারীদের

কী ভয়ংকর!

শান্তি এখন খুব প্রয়োজন

শান্ত হোন

সংযোগ সড়কহীন সেতু

যা করণীয়

নিরাপত্তাহীনতা

আজ বিজয়ের দিন

রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতারণা