হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

নারীদের পথে নানা বাধা

মাসুমা হক প্রিয়াংকা

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি একধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে নারীদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে নানা বাধা দেখা যাচ্ছে। এসব ঘটনা শুধু বিচ্ছিন্ন কিছু প্রতিবন্ধকতা নয়; বরং বৃহত্তর সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন।

একটি সমাজের প্রকৃত অগ্রগতি নির্ভর করে তার নাগরিকদের সমান সুযোগ ও অধিকার নিশ্চিত করার ওপর। বাংলাদেশের সংবিধান নারীর সমান অধিকারের নিশ্চয়তা দিলেও বাস্তবতা হচ্ছে, নারীরা এখনো বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হন। খেলাধুলা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মতো খোলামেলা প্ল্যাটফর্মে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো কিছু গোষ্ঠীর কাছে হুমকিস্বরূপ মনে হয়। এসব গোষ্ঠী মূলত ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার জন্য নারীদের স্বাধীনতাকে সংকুচিত করতে চায়। এটি কোনো নতুন ঘটনা নয়; অতীতেও দেখা গেছে, যখনই সমাজে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তখনই নারীর ভূমিকা সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে।

নারীদের খেলাধুলার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বাধাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, এটি শুধু একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর চাপের কারণে হচ্ছে না; বরং প্রশাসনিক শৈথিল্যের কারণেও এসব ঘটনা ঘটছে। কিছু বিশেষ গোষ্ঠী নারীদের মাঠে নামাকে ‘অনৈসলামিক’ বলে প্রচার করছে, যা সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানোর একটি কৌশল। অথচ খেলাধুলা শুধু শারীরিক সক্ষমতার প্রকাশ নয়; বরং এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। নারী ফুটবল দল যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য এনে দিয়েছে, তখনই এই বাধা আসা প্রমাণ করে যে সমাজের একটি অংশ নারীর ক্ষমতায়নকে ভয় পাচ্ছে।

সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় সংস্কৃতি ছিল প্রতিরোধের একটি বড় মাধ্যম। কিন্তু বর্তমানে কিছু গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ধর্মের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ হিসেবে প্রচার করছে, যা সমাজে একধরনের সংকীর্ণতা তৈরি করছে। গান, নাটক, নৃত্য, চিত্রকলা—এসব মানবিকচর্চা নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে তারা মূলত সমাজকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ করতে চায়, যেখানে প্রশ্নহীন আনুগত্য থাকবে, কিন্তু সৃজনশীলতা থাকবে না।

একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে তার নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা। নারী অধিকার, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা সংবিধানে স্বীকৃত হলেও প্রশাসনের শৈথিল্যের কারণে এসব অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। সরকারকে অবশ্যই এসব ঘটনায় কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে হবে যে কোনো গোষ্ঠী নারীদের খেলাধুলা কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ বন্ধ করতে পারবে না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। যারা নারীদের মাঠে নামা বা মঞ্চে ওঠার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় প্রশাসনকে সাহসী হতে হবে এবং নারীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কিশোর-কিশোরীদের মনে উগ্র চিন্তাভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, যা পরবর্তী সময়ে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পাঠ্যপুস্তকে মুক্তচিন্তার জায়গা আরও সম্প্রসারিত করা উচিত, যাতে নতুন প্রজন্ম ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদকে গ্রহণ করতে শেখে।

সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সচেতন নাগরিকদের উচিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা, যাতে নারীদের অধিকার কেউ খর্ব করতে না পারে। শুধু ফেসবুকে স্ট্যাটাস বা প্রতিবাদ করা যথেষ্ট নয়; বরং মাঠপর্যায়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

সংস্কৃতিকর্মীদের আরও সংগঠিত হওয়া দরকার। একসময় বাংলাদেশে গণসংগীত, নাটক ও চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করা হতো। এখন আবার সেই চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হয়, তবে সমাজ একধরনের মূর্খতার দিকে ধাবিত হবে।

নারীদেরও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে এবং প্রতিকূলতার মুখে থেমে না গিয়ে আরও বেশি অংশগ্রহণ করতে হবে। ইতিহাস সাক্ষী, প্রতিটি সমাজে যখনই নারীরা সংগঠিত হয়েছে, তখনই পরিবর্তন এসেছে। নারীদের নেতৃত্ব আরও দৃঢ় করতে হবে এবং তাদের চারপাশের মানুষদের সচেতন করতে হবে।

বাংলাদেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য উগ্রপন্থীরা বারবার ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের মাঠ ও মঞ্চ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। এটি শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়; বরং সামগ্রিকভাবে একটি উদার ও বহুমাত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে একধরনের যুদ্ধ। যদি এখনই প্রতিরোধ গড়ে না তোলা হয়, তবে ভবিষ্যতে এই সংকট আরও গভীর হবে। তাই রাষ্ট্র, সরকার, প্রশাসন, নাগরিক সমাজ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সবাই মিলে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। নারীর অগ্রযাত্রা রুখে দেওয়ার চেষ্টা শুধু নারীদের ক্ষতি করবে না, বরং এটি পুরো সমাজকে পিছিয়ে দেবে। অতএব এই সংকটকে সাময়িক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভেবে উপেক্ষা না করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

মাসুমা হক প্রিয়াংকা, সমাজকর্মী ও শিক্ষার্থী

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে