শনিবার বিকেল ছবিখানা আদতে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বানাননি! এই সিনেমাটা ফারুকী লেখেননি, আঁকেননি, ভাবেননি।
প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই ভাবছেন এই মিথ্যে কথাগুলো কী করে বলে গেলাম। কী অবাক ব্যাপার দেখুন তো, কোনো ডিসক্লেইমার ছাড়াই আপনি সত্য-মিথ্যা ধরতে পারছেন, অথচ সিনেমায় ডিসক্লেইমার থাকার পরও, গল্প মানেই যে মিথ্যে কথা, তা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত সত্য হলেও আমরা অনেকেই কেন কল্পনাপ্রসূত সিনেমার ভেতর সত্য খুঁজি, আঘাত পাই; ১০ বছর আগেও তো আমাদের অনুভূতি ভাবমূর্তি ইত্যাদি মিথ্যে গল্প দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত হতো না। কোনো মন্দ চরিত্রের নির্দিষ্ট পেশার জন্য পুরো পেশাজীবী সমাজের ভাবমূর্তিতে আঘাত লাগত না।
কী হয়ে গেল আমাদের?
সত্য পৃথিবীর সকল অপরাধ আমরা সয়ে যাওয়া শিখলাম, আর মিথ্যে পৃথিবীর সকল কিছুতে আঘাত পেতে লাগলাম। সত্য পৃথিবীতে আমার পোশাকের, লেবাসের, পেশার কোনো কেউ অপরাধ করলে আমদের অনুভূতি, ভাবমূর্তিতে আঘাত লাগে না, সেটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবি। অথচ সিনেমায় আমার লেবাসের মন্দ মানুষ দেখলেই আমি ক্ষেপে উঠি!
কী হয়ে গেল আমাদের?
আমরা ভুলেই যাই যে, সিনেমায় যে সত্যটা থাকে, সেটা লেখকের নিজের তৈরি পৃথিবীর সত্য, সেই পৃথিবীর লজিক, সেই পৃথিবীর রিয়েলিজম। নির্মাতা সেই পৃথিবী সুন্দরভাবে তৈরি করতে পারলে আপনি ম্যাট্রিক্সের কল্প পৃথিবী উপভোগ করেন, ডুবে যান, কিয়ানো রিভসের সকল আচরণ আপনার লজিক্যাল লাগে, টেনেটের ‘রিভার্স টাইম’-এ আপনি হারিয়ে যান, ‘স্যান্ডম্যান’-এর স্বপ্নের দুনিয়ায় আপনি ডুবে যান। সেই পৃথিবী তৈরিতে অদক্ষতা থাকলে ধর্মেন্দ্র সাব যখন হাত দিয়ে বুলেট ঠেকিয়ে দেন, তখন আপনি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খান। (দেশি উদাহরণ দেওয়া ‘সম্ভব’ হলো না কারণ, আমি অনুভুতিঅলাদের ‘অসম্ভব’ ডরাই!)
আরেক ধরনের সাহিত্য বা সিনেমা আমরা দেখি, যেটা কোনো সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কল্পনার আশ্রয়ে তৈরি করা হয়; যেমন-প্রথম আলো বা দেয়াল। যেমন ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড’-এ আমরা হিটলারের ‘হোয়াট ইফ’ পরিণতি দেখি। আরেক ছবিতে আমেরিকার মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে ভ্যাম্পায়ার শিকার করতে দেখি। আরেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডিকে কত ছবিতে যে কতভাবে, কতজন দ্বারা মারা হলো, তার তো হিসাব নেই। এগুলো আবার ইতিহাসের ধারে-কাছেও নেই, সব লেখক, নির্মাতার কল্পনা।
ধরা যাক, কোনো দেশি সিনেমার গল্পটা গড়ে উঠল একটা ডিসটোপিয়ান সোসাইটি ঘিরে, যে টাইমলাইনে দেখানো হলো বাংলাদেশের জন্মটাই হয়নি এখনো, ইংরেজ করপোরেটরা উপনিবেশ স্থাপন করে পুরা ভারতবর্ষ শাসন করছে। এই মাটিতে গান্ধীজি জন্মাননি, নেতাজি জন্মাননি, ভগত সিং, মাস্টারদা সূর্য সেন জন্মাননি, বঙ্গবন্ধু জন্মাননি, জাতীয় চার নেতা জন্মাননি। যে কারণে ৪৭ আসেনি, ৫২ আসেনি, ৭১ কখনো আসেনি। এই অঞ্চলের মানুষ দাসত্ব বরণ করেছে। মানুষ প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে, নিয়তি ভেবে সব মেনে নিয়েছে। একদিন এই দাসদের ভেতর থেকে হয়তো একজন সাইবর্গ উঠে দাঁড়ায় পুরো সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। সকল অ্যানার্কি, দুর্নীতি, আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে। কারণ তার আধা সিনথেটিক মগজে, ভয়টাও আধা! গল্পটা তার দাস থেকে পুরো মানুষ হয়ে ওঠার জার্নিটা নিয়েই।
এখন এই সিনেমাটা বানালে কি মহান মুক্তিযুদ্ধ মিথ্যে হয়ে যাবে? ভগত সিং, সূর্যসেন থেকে শুরু করে আমাদের জাতির জনক আর জাতীয় চার নেতার বীরত্বের ও আত্মত্যাগের মহান ইতিহাস মুছে যাবে? পৃথিবীবাসী আমাদের ইতিহাস ভুলে যাবে? মানুষ সুপারশপে গিয়ে মেকানিক্যাল হাত-পা খুঁজবে? এটা কখনোই হবে না। কারণ, মানুষ সজ্ঞানে একটা মিথ্যে গল্পের, মিথ্যে পৃথিবীর সিনেমাটিক প্রেজেন্টেশন দেখতে সিনেমা হলে যাবে, ইতিহাসের সঙ্গে মেলাতে নয়। মানুষ বুঝবে এটা ফিকশন, ডকুমেন্টারি নয় কোনোভাবেই।
এই যে গল্প তৈরির এই প্রবণতা, ভাবলে ভুল হবে এই চর্চা সাম্প্রতিক। মানুষের মুখে যখন কোনো ভাষা ছিল না, সেই আমলে তারা ছবি এঁকে গল্প বলত। সেই চেষ্টারই আধুনিকতম রূপ হচ্ছে শব্দ, আর চলমান ছবির মিশ্রণে তৈরি সিনেমা। আর মানুষের এই সহজাত কল্পনা, সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়া মানে উল্টো দিকে হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে গুহামানবেরও আগের সময়ে চলে যাওয়া, যখন মানুষ আর বন্য প্রাণীর মধ্যে ন্যূনতম পার্থক্য ছিল না।
প্রশ্ন ওঠে, এই আধুনিক সময়ে সিনেমা কি আসলেও আটকে রাখা যায়? হাস্যকর রকমের ভুল-ভ্রান্তিতে ভরা নেটফ্লিক্সের এক্সট্রাকশন কি আটকানো গেছে? সেই অসত্য কল্পনাকে কি দর্শক বিশ্বাস করেছে?
দর্শক শুধু বিনোদনটা নিয়েছে, সেই অসত্য সিনমাটিক ওয়ার্ল্ডের এক্সপেরিয়েন্সটা নিয়েছে। সিনেমা ব্যাপারটাই তাই, নির্মাতা তার একটা পৃথিবী তৈরি করেন, সচেতন নির্মাতা কিছু প্রশ্নের খোঁজ করেন। যাপিত জীবনের মতো বিশ্বাসযোগ্য করে একে নির্মাণ করেন। আর দর্শক সেই পৃথিবী পরিভ্রমণ করে রস আস্বাদন করে অথবা করতে পারে না। হ্যাঁ, আর্ট বা সিনেমার একটা প্রভাব থাকে। ঠিক যে কারণে আমরা সিনেমার ভায়োলেন্স উপভোগ করতে পারি। কিন্তু পরিচালক সেই ভায়োলেন্সকে যদি উদ্যাপন করেন, ফেস্টিভ্যালের আকার দেন, তখন আমরা সেই ন্যারেটিভকে উৎসাহ দিই না। সিনেমায় নারী নির্যাতনের ঘটনা থাকতে পারে। কিন্তু সেটা যখন উদ্যাপিত হয় হিরোয়িক অ্যাক্ট হিসেবে, তখন আমরা প্রশ্ন তুলি সেই পরিচালকের সভ্যতা, ভব্যতা ও দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু এমনটা কখনোই বলি না যে, অমুক ছবি দেখানোর অধিকার তার নেই এবং ঠিক এ কারণেই সিনেমার মুক্তি জরুরি, দর্শকই আসল বিচারক। সিনেমায় দেশের জন্য ক্ষতিকর, হাস্যকর বা অপমানজনক কিছু থাকলে দর্শকই রুখে দাঁড়াবে। সেন্সর বোর্ড নামের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা শুধু বাধাই তৈরি করে, উন্নত দেশগুলোতে তাই সেন্সর নয়, সিনেমাকে সার্টিফাই করা হয় বয়সভেদে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আমরা তো উন্নত দেশের অভিমুখেই চলমান ছিলাম!
হঠাৎ কী হয়ে গেল আমাদের?
পরিশেষে বলতে চাই এই ডিজিটাল যুগে কোনো রাষ্ট্র বা কোনো গোষ্ঠী সিনেমা আটকে রাখতে পারে না। কারণ কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় তার মুক্তি ঘটেই। রাষ্ট্রের এও মনে রাখা উচিত যে গোষ্ঠীর উদ্দেশ্যই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা, তারা তা করবেই। কারণেও করবে, অকারণেও করবে। সেই জুজুর ভয়ে শিল্পের প্রকাশ রুদ্ধ করা মানে অন্ধকারের শক্তিকে আরও বলবান করে দেওয়া। সচেতন দর্শকের উচিত শিল্পের মুক্তির জন্য আওয়াজ তোলা। কারণ আপনারাই সরকার, আপনারাই রাষ্ট্র, আপনারাই প্রাণ। আপনারা চাইলে কী না ঘটে?
‘পমান’ দিব?
‘শিভোল্যুশন’ নামে আমার/আমাদের একটা এনথোলজি ফিল্ম একটা ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সাবসক্রিপশন ছাড়া দেখা যেত না। দর্শক একদিন আওয়াজ তুলল, এই গুরুত্বপূর্ণ ছবিটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হোক। সেই রাতেই কর্তৃপক্ষ ফিল্মটি পাবলিকলি এক্সেসিবল করে দিল।
তারা যেমন রক্ত-মাংসের বোধসম্পন্ন মানুষ, বাংলাদেশ সেন্সর বোর্ডের কর্তারাও রক্ত-মাংসের বোধসম্পন্ন মানুষ। শুধু দরকার আপনাদের আওয়াজ, সিনেমাটা দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। আপনারাই সকল শক্তির উৎস।
শনিবার বিকেল আরেকটি ফারুকী নির্মাণ নয়, এটি ফারুকীর একটি অনন্য নির্মাণ!
লেখক: আঁকিয়ে, নির্মাতা