হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

‘মব’ আমাদের সংস্কৃতির অংশ নয়

ড. মো. গোলাম রহমান

প্রতীকী ছবি

সংবাদপত্রের পাতায় প্রতিদিন অসংখ্য সংবাদ ছাপা হয়, পাঠকেরা সেসব পাঠ করেন। বিশ্বে গণমাধ্যম নিয়ে আলোচনায় দেখা যায়, বেশির ভাগ সংবাদ নিয়ে পাঠকেরা তেমন মাথা ঘামান না। তবে হঠাৎ কোনো কোনো সংবাদ তাঁদের মনে দাগ কাটে। শুধু দাগই কাটে না, বেশ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। যে কারণে সংবাদ প্রকাশ একটি দায়িত্বপূর্ণ কাজ। হেলাফেলায় এই কাজটি সমাধা করার কোনো সুযোগ নেই। সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড কিংবা রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি—এসব বিষয়ে কমবেশি পাঠকের আগ্রহ থাকে এবং এই আগ্রহের চাহিদা থেকেই তৈরি হয় সংবাদমাধ্যমের দায়বদ্ধতা। সাংবাদিকেরা যথেষ্ট শ্রম ও ঘামে সংবাদ সংগ্রহ করে সেগুলোকে পাঠকের পাঠ করার উপযোগী করে পরিবেশন করে থাকেন। কোনো কোনো সংবাদ সমাজে শুধু প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে না, বরং সমাজ প্রগতির অংশ হিসেবে মানব কল্যাণে অবদান রাখে।

যখন দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলি পাঠককে নানা চিন্তায় দোলাচলে ফেলে, তখন কোনো কোনো সংবাদ তাঁদেরকে বেশ বিড়ম্বনায়ও ফেলে। এমন একটি সংবাদের প্রতি দৃষ্টি পড়ে গত শনিবার। আজকের পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত একটি সংবাদ, যার শিরোনাম, ‘মব সৃষ্টি করে ১০ মাসে ১৭২ জনকে হত্যা’। সংবাদটি হচ্ছে: ‘রাজধানীর দারুস সালামের দ্বীপনগর এলাকায় গত ৩১ মে মাইকিং করে তানভীর ও ফাহিম নামের দুই তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করে স্থানীয়রা। স্থানীয়সহ পুলিশের দাবি, নিহতরা মাদক কারবারি। এ কারণে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁদের পিটিয়ে হত্যা করে। পরদিন একই এলাকা থেকে রাসেল নামের এক কিশোরের রাস্তায় পড়ে থাকা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। দারুস সালাম জোনের সহকারী কমিশনার ইমদাদ হোসেন জানিয়েছেন, নিহত তানভীর ও ফাহিম মানুষকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন, স্থানীয়রা ক্ষিপ্ত হয়ে পিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই তাঁরা মারা যান।’

এই সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ১০ মাসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৭২ জনকে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) দাবি করেছে। তাঁরা আরও বলেছে, কোথাও চোর-ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ এবং কোথাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ও দোসর অপবাদ দিয়ে মব সৃষ্টি করে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

মানবসমাজের কত দূর অপমান ও অবমাননা হলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা ভেবে পাই না। সৃষ্টিকর্তার মহান সৃষ্টির এই অধঃপতন কি শুধু বাংলাদেশে? সারা বিশ্বে আজ এমন ঘটনার অনেক উদাহরণ হয়তো পাওয়া যাবে কিন্তু তারপরও আমাদের এই সোনার বাংলায় এমন সামাজিক অধঃপতনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে, এটা কি ভাবা যায়? আইনের শাসনের চরম অধঃপতনের নজির সৃষ্টি করে চলেছি আমরা। সারা বিশ্ব যখন জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চায় ধাবমান, উন্নত জীবনব্যবস্থার প্রতি অঙ্গীকার নিয়ে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা রাজনীতির হিসাব কষছি, সরকারব্যবস্থার ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করছি আর মানুষের জীবন নিয়ে ছেলেখেলা করছি। মানুষের কল্যাণে মানবিক আচরণ না করে মানুষ হত্যার খেলা দেখছি। কী দুঃসহ এ জীবন! কী অমানবিক আমাদের আচরণ!

প্রায়ই শোনা যায় কিশোর গ্যাংয়ের কথা। সমাজের এক অধঃপতিত অবস্থারই প্রতিফলন হচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের দিগ্‌ভ্রান্ত এমন আচরণ। নইলে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কিশোরেরা এমন আচরণ কীভাবে করতে পারে? পরিবারের বন্ধন কি শিথিল হয়ে গেল? একটি পরিবারে ছেলেমেয়েরা বয়ঃসন্ধি কাল পেরিয়ে প্রকৃত নাগরিক দায়িত্ব পালন করবে, এটাই তো কাম্য। অথচ আজকাল পিতামাতা কিংবা অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তান মানুষ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। তাদের সুপথে চালাতে পারছেন না। যাঁরা পারছেন না, তাঁদের আহাজারি কি আমরা শুনতে পাই না?

মব সৃষ্টি করে মানুষ মারা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই সমানভাবে দায়ী হতে পারে এবং এই ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এটা আমরা জানি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্প্রতি বলেছে, আইন নিজের হাতে তুলে না নিতে। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ করা হলেও এই সমাজ মব ও গণপিটুনি প্রতিরোধ করতে পারছে না। তবে এবার কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনাবাহিনী। সম্প্রতি কিছু ঘটনা প্রতিহত করেছে পুলিশ, র‍্যাব ও সেনাবাহিনী। সংবাদে প্রকাশ, গত ১৬ মে ধানমন্ডিতে একজন প্রকাশককে ধরার জন্য মব সৃষ্টি করে কয়েকজন যুবক। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশকে চাপ দেয় তারা, তবে ধানমন্ডি থানার ওসির দৃঢ় তৎপরতায় সেই মব প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।

আরেকটি খবর আজকের পত্রিকায় ১৫ জুন বের হয়েছে। এটিও পিটিয়ে হত্যা করার সংবাদ: ‘বগুড়ায় মেয়েকে বিয়ে না দেওয়ায় বাবাকে তুলে নিয়ে স্থানীয় বখাটেরা পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল শনিবার বিকেলে বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী এলাকায় এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বগুড়া শহরের ফুলবাড়ী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আলমাস আলী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহতের নাম শাকিল আহমেদ (৪০)। ...পেশায় রিকশাচালক। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাকিল শিববাটি এলাকায় একটি বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে বসবাস করেন। তাঁর এক কিশোরী কন্যাকে স্থানীয় এক ব্যক্তি বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তির বয়স অনেক বেশি হওয়ায় শাকিল বিয়ের প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না।...গতকাল দুপুরের দিকে ১০-১৫ জন বখাটে যুবক শাকিলকে বাড়ি থেকে ফুলবাড়ী এলাকায় করতোয়া নদীর ঘাটে নিয়ে যায়। মেয়ের বিয়ে না দেওয়ার কারণে সেখানে শাকিলকে বেদম মারধর করা হয়। পরে তাঁকে নদীর ঘাটে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় বখাটেরা।’

স্থানীয় লোকজন শাকিলকে উদ্ধার করে বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তিনি মারা যান। এই ঘটনায় যেকোনো ব্যক্তির মনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে জনগণের জীবনের নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? মানুষের সাধারণ নিরাপত্তা বলতে কি কিছু থাকবে না? মানুষ এত অসহিষ্ণু কেন হচ্ছে? সমাজের এই অবস্থা কেন হচ্ছে? আমাদের সমাজে বিয়ে শুধু দুজন নারী-পুরুষের বন্ধন নয়। এটি হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপনের স্বীকৃত পদ্ধতি। এখানে জোরজবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। অথচ মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার চরমে পৌঁছে গিয়ে যা খুশি তা-ই করার চেষ্টা করছে। সমাজের স্বীকৃত রীতিনীতি, ভদ্রতা, নম্রতা—কোনো কিছুরই মূল্য নেই। তাহলে এসবের প্রতিকার কী? বিচারের বাণী কি নীরবে-নিভৃতে কেঁদে ফিরবে? জানা যায়, এ ঘটনায় পুলিশ দুই বখাটেকে আটক করেছে।

আমরা জানি যে থানার পুলিশের এই ধরনের পদক্ষেপ সব সময় খুব কার্যকর সমাধান দেয় না। অনেক সময় শুধু লোকদেখানো কার্যক্রম হিসেবে এসবের দেখা পাওয়া যায়। এ ছাড়া কোর্টকাছারিতে লাখ লাখ মামলার জট এবং ঐতিহাসিকভাবে চলে থাকা বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রতা মানুষকে বিচারপ্রাপ্তি থেকে নিরুৎসাহিত করে। বিভিন্ন সময়ে বাদী-বিবাদীগণকে বিচারের ফলাফল দ্রুত পৌঁছানোর প্রচেষ্টা হিসেবে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর কথাও আমরা শুনে আসছি। অল্পস্বল্প কাজ এ ক্ষেত্রে হয়েছে বটে, কিন্তু ঔপনিবেশিক চিন্তাচেতনায় এবং গড়ে ওঠা প্রশাসনিক কাঠামোতে তার খুব বেশি ফলপ্রসূ প্রয়োগ জনগণ এখনো দেখেনি।

তারপরও জনগণ প্রত্যাশা করে যে বিচারব্যবস্থার উন্নয়ন অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর হবে। তাতে করে দেশের মানুষের উন্নয়ন বিষয়ে যে ভাবনা, তা যেমন কার্যকর হবে, একই সঙ্গে সমাজের অন্য অনেক বিষয়ের সমাধান দ্রুত নিষ্পন্ন হবে।

যদি আমরা মৌলিক কোনো চিন্তাভাবনা এসব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে এগোতে পারি, তাহলে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতির সব বিষয়ে সংস্কারের যে প্রস্তাব হচ্ছে, তার অন্তর্নিহিত শক্তিটি উজ্জীবিত হবে। সমাজ তো রাতারাতি পাল্টায় না। সমাজে মহান কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন যদি মহৎ কোনো ধ্যানধারণার আলোকবর্তিকা নিয়ে জনগণের সামনে উপস্থিত হন, তখনই সমাজ নতুন দিকনির্দেশনা নিয়ে এগিয়ে যায়। আমাদের তরুণ মানবগোষ্ঠী নতুন আলোয় উজ্জীবিত হবে, এটাই তো প্রত্যাশা। তাই সমাজ প্রগতির ধারায় জ্ঞানবিজ্ঞানে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই সমাজে যেন ‘মব’-এর হাতে নিরীহ মানুষের আর প্রাণ দিতে না হয়। ‘মব’ যেন আমাদের সমাজে কোনো ভয়াল ক্ষত সৃষ্টি না করে, এ প্রসঙ্গে বিচারহীনতার কোনো সুযোগ যেন তৈরি না হয়। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে যেন ‘মব’ শব্দটি স্থায়ী আসন গেড়ে না বসে।

অসময়েই শত্রু-মিত্র, মীরজাফর ও বিশ্বাসঘাতককে চেনা যায়

খেলা কি তবে এবার মুখ ও মুখোশের

বুদ্ধিজীবী দিবস যেন ভুলে না যাই

উড়োজাহাজগুলোও পরিবেশের ক্ষতি করছে

যে প্রশ্নগুলোর জবাব পেতে হবে

পুতিনের ভারত সফর: আঞ্চলিক ও বিশ্বরাজনীতিতে কী বার্তা দেয়

বিজয়ের মাসে শঙ্কার কথা বলি

পথকুকুর-বিড়াল হত্যা: আইন এবং শাস্তি

জীবনের অপরিহার্য অংশ সংগীত ও শরীরচর্চা

দুর্নীতি রোগে আক্রান্ত আফ্রিকা