সাক্ষাৎকার

ভবিষ্যতেও তরুণেরাই রাস্তায় নামবে

ইমতিয়াজ আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বর্তমানে তিনি ‘অলটারনেটিভস’ সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক। সাম্প্রতিক নেপালের গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার মাসুদ রানা

অল্প দিনের আন্দোলনে নেপালের সরকার পড়ে গেল। একই জিনিস আগে দেখা গিয়েছিল আরব দেশগুলোতে, এরপর দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশে। এই প্রবণতা বাড়ছে কেন?

এটা বাড়ছে এ কারণে যে মানুষের অভিব্যক্তি বাড়ছে। যাঁরা রাষ্ট্রের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের সঙ্গে জনগণের একটা গ্যাপ তৈরি হয়েছে। আবার এই গ্যাপটা অনেকের চোখে পড়ছে। জনগণ দেখতে পাচ্ছে, শাসকদের সন্তান এবং আত্মীয়স্বজনেরা বিলাসী জীবনযাপন করছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা দেশের বাইরে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ সেই সব সরাসরি দেখতে পাচ্ছে। যেটা আগে এত সহজে দেখা যেত না। প্রযুক্তির কারণে আবার জনগণের মধ্যে সেসবের মোবিলাইজ করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। তারা কোনো দল, সংগঠন বা কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত না থাকার পরেও সেসব মোবিলাইজ করতে পারছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেসব দৃশ্য দেখার পর জনগণ নিজের পরিবার এবং নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খুঁজে পাচ্ছে না। একই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালকদের ব্যর্থতার কারণে তিউনিসিয়া, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ এবং সবশেষ নেপালে জনগণের ক্ষোভ প্রকাশ দেখা গেল।

এখন দেখার বিষয় বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন কারণে এ ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে মিল একটা জায়গায় ঘটেছে তা হলো, প্রযুক্তির প্রভাবের কারণে সব দেশে এটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংগঠিত হয়েছে। এসব ঘটনায় এটা প্রমাণিত হয়েছে, যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা কথা দিয়ে কথা রাখতে পারেননি। তবে এসব ঘটনায় বিদেশি বিভিন্ন শক্তি এবং দেশীয় শক্তিগুলো সক্রিয় এবং সুযোগ নিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণেই ঘটনাগুলো স্ফুলিঙ্গ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে জনগণের মধ্যে। কারণ, শাসকদের সঙ্গে সাধারণ জনগণের দূরত্বটা বিদ্যমান আছে বলে।

যদি দূরত্বটা না থাকত তাহলে সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন হতো এবং তাঁরা জনগণের জন্য কাজ করতেন। আর রাষ্ট্র পরিচালকদের সন্তানেরা দেশের মধ্যে থাকতেন, তাহলে আমার কাছে মনে হয় এ ধরনের ঘটনা না-ও ঘটতে পারত।

দুর্নীতি এবং লৌহ শাসন বর্তমান সরকারগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছে কেন? এই অস্থিরতা তৈরির কারণ কী বলে মনে করেন?

বিশ্বের সব দেশে কম-বেশি দুর্নীতি আছে। কিন্তু কথা হলো, সরকারগুলো কীভাবে সেটা ব্যবহার করছে? সরকারি লোকজন যদি দুর্নীতির মধ্যে লিপ্ত থাকে, বিশেষ করে তাদের সন্তানেরা যদি দেশের মধ্যে না থাকেন এবং বিদেশে অবস্থান করে সেখানে আরাম-আয়েশের জীবনযাপন করে থাকেন, তাহলে দুর্নীতি একটা বড় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং বিভিন্ন মহল এটাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করবে।

আমরা যখন কথা বলছি, তখন ফ্রান্সে বিশাল বড় আন্দোলন হচ্ছে। যদিও মেইনস্ট্রিম ইলেকট্রনিকস ও প্রিন্ট মিডিয়া এটাকে সেভাবে প্রচারে আনছে না। সেখানেও কিন্তু রীতিমতো বাড়িঘর, গাড়ি পোড়ানো হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষ হচ্ছে। এখন ফ্রান্সে হচ্ছে, কিছুদিন আগে নেপালে দেখলাম এবং এক বছর আগে বাংলাদেশেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আবার ভারত তো একধরনের সংঘর্ষ এবং সংগ্রামের মধ্যে আছে। বিভিন্নভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে বিশ্বের নানা দেশে। সেটাকে একভাবে দেখা ঠিক হবে না।

নেপালে উদ্ভূত পরিস্থিতি খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। আমরা কেন তাতে ব্যর্থ হলাম বলে মনে করেন?

হ্যাঁ, নেপাল সেটা তাড়াতাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। বাংলাদেশ কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পরেও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এখন বাংলাদেশের করণীয় হলো, দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া। সরকারকে দেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা। সেখানে আমাদের এখনো কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। নেপালে প্রথম পর্বেই যাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই কিন্তু নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। শুধু মাস নয় কিন্তু, নির্দিষ্ট তারিখও ঘোষণা করেছেন। এতে জনগণও বুঝতে পেরেছে, যিনি দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কোনো ইচ্ছা নেই। তাঁরা এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ থেকে কোনো শিক্ষা নিয়েছেন কি না, সেটা আমার জানা নেই। তবে এটা পরিষ্কার যে তাঁরা মাত্র ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। সে জায়গায় বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের একটা বড় ধরনের ভিন্নতা আছে।

ইন্টারনেট এখন তরুণদের কাছে টাইম বোমার মতো হয়ে গেছে। এমনিতে তারা রাজপথে আসে না, নেটেই নিজেদের ব্যস্ত রাখে। কিন্তু নেট না থাকলে তারা শুধু রাজপথেই নামে না, সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে প্রস্তুত। এটা কি প্রযুক্তির যান্ত্রিক অভ্যস্ততার কারণে হয়েছে?

এসব ঘটনায় শুধু তরুণদের দোষ দেওয়ার কোনো কারণ নেই। তরুণেরা সব সময় আন্দোলনের মধ্যে ছিল। এটা শুধু এখনকার বিষয় নয়। আমি যদি বায়ান্ন, একাত্তরের কথা বলি, সেখানে কিন্তু তরুণদের বড় ভূমিকা ছিল। এটা শুধু এখনকার বা অতীতের বিষয় না, ভবিষ্যতেও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণেরাই দায়িত্ব পালন করবে। এটা শুধু আমাদের দেশের বিষয় না। এখন যে ফ্রান্সে আন্দোলন হচ্ছে, সেখানেও প্রথমে তরুণেরাই রাজপথে নেমেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফিলিস্তিনের পক্ষে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর বিপক্ষে তরুণেরাই নেমেছে। আমেরিকায় যারা গাজার পক্ষে নেমেছে, তারাও তরুণ। ৪০টি দেশের লোক নৌকায় করে যে গাজা অভিমুখে ত্রাণ নিয়ে রওনা হয়েছে, তারাও তরুণ।

এখন তরুণদের জেন-জি বলা হচ্ছে, তার মধ্যে একটা রাজনীতি থাকতে পারে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এই তরুণদের অরাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, ফ্রান্স, বাংলাদেশ, নেপাল ও আমেরিকার ঘটনায় তরুণদের বেশি দেখা যাচ্ছে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে। এটা সম্ভব হচ্ছে প্রযুক্তির কারণে। কারণ, এখন সবার হাতের মধ্যে মোবাইল।

আর একটা বিষয়, ৭০-৮০ বছর ধরে ফিলিস্তিনের ওপর জেনোসাইড চলে আসছে। কিন্তু কয়েক বছরে ধরে আমেরিকার জনগণ বেশি এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় ভূমিকা পালন করেছে। বিশেষ করে রিলস, টিকটক ও ভিডিওর মাধ্যমে চাক্ষুষ গাজাবাসীর ওপর নির্মমতা তারা দেখতে পেয়েছে। এসব ঘটনায় তরুণেরাই বড় ভূমিকা পালন করছে।

আমি মনে করি তরুণেরা সব সময় আন্দোলনে ছিল। কারণ, কোনো আন্দোলনে আগে বয়স্করা নেমেছেন, সেটা দেখা যায়নি। তরুণেরাই শুরু করেছে, তারপর অন্যরা যুক্ত হয়েছে। এখন তরুণদেরকে যে দোষ দেওয়া হচ্ছে, সেটা আমি ঠিক মনে করি না। ভবিষ্যতেও তরুণেরাই রাস্তায় নামবে, যদি কোনো পরিস্থিতি আবার তৈরি হয়।

উগ্র জাতীয়তাবাদ, উগ্র ডানপন্থা, অভিবাসনবিরোধী মনোভাব, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি বেড়ে ওঠার কারণ কী?

এটার বড় কারণ হলো জনগণের ক্ষোভ রাষ্ট্র পরিচালকেরা মেটাতে পারছেন না। অনেক দেশই মনে করছে, বিদেশি শক্তি বা বিশ্বায়নব্যবস্থা এর জন্য দায়ী। বিশেষ করে আমরা যদি পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকাই, সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। তাদের ধারণা, এসব অভিবাসীদের কারণে হচ্ছে। এ কারণে একটা কট্টর জাতীয়তাবাদী ধারণাও প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে। রীতিমতো শ্বেতাঙ্গ বিপ্লব শুরু হয়েছে ইউরোপ, আমেরিকার নানা দেশে। এসবের একটা ইমপ্যাক্ট অন্যান্য দেশেও পড়ছে। কারণ, তারা মনে করছে বাইরের শক্তি বা বাইরের জনগণ এসব করছে। ফলে ক্রমেই উগ্র জাতীয়তাবাদীর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু প্রতিটি দেশে একটা বড় সমস্যা রয়ে গেছে। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন তাঁরা যদি জনগণের চাহিদা মেটাতে পারতেন, অবস্থার পরিবর্তন করতে পারতেন এবং তাঁদের সন্তানদের জীবনমান সাধারণ মানুষের মানের মতো থাকত, তাহলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। বিশ্বের অনেক দেশেই এ রকম কোনো সমস্যা নেই। কারণ, সেসব দেশের সরকার জনগণের চাহিদা মেটাতে পারছে।

এ ধরনের আন্দোলন না হতে পারে যদি সরকারগুলো জনগণের প্রতি মনোযোগ দেয় এবং তাদের চাহিদাগুলো পূরণ করে। এগুলো না মেটাতে পারলে ভবিষ্যতে আরও বড় ধরনের সংঘর্ষ ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়।

বিভিন্ন দেশে যাঁরা আগে থেকে রাজনীতি এবং ক্ষমতার চর্চা করে আসছেন, তাঁদের মধ্যেও ব্যর্থতা আছে। এখন মূল ব্যাপারটাই হলো জনগণের চাহিদা পূরণ করা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে সেই ব্যর্থতা থেকে নতুন মুখ দেখতে চাইছে। যদি ক্ষমতাসীনেরা জনগণের চাহিদাগুলো মেটাতে পারে, তাহলে ভবিষ্যতে সংঘর্ষের মাত্রা কমে আসবে।

ভোগবাদিতার কারণেই শাসকদের মধ্যে দুর্নীতি ও অনাচার করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই প্রবণতা কমার উপায় কী?

এটার জন্য জনগণকে আগে সচেতন হওয়া দরকার সব ক্ষেত্রে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর বাইরে কাঠামোগত পরিবর্তনও দরকার। মানে কিছু কিছু কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে দুর্নীতি করে পার পেয়ে যায়। সেই জায়গাগুলোকে নতুনভাবে পরিবর্তন করা দরকার। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে ভালো কোনো ব্যক্তি সেটা পরিবর্তন করছেন। কিন্তু নতুন যিনি দায়িত্ব নিচ্ছেন তিনি দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরই আবার আগের মতো দুর্নীতির মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। এর কারণ হলো, যিনি কাঠামোগত কারণে যে ক্ষমতাটা পান তিনি ভালো করেই জানেন—আমি যদি এখন দুর্নীতি করি তাহলে আমি পার পেয়ে যাব। এই যে পার পেয়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে আগে রোধ করতে হবে। তারপর কাঠামোর কারণে দুর্নীতি করার যে সুবিধা করে দেওয়া হয়, সেটারও পরিবর্তন করা প্রয়োজন।

আমি ভাবতে পারি না যে বাইরের কোনো শক্তি এটার পরিবর্তন করে দিতে পারে। এ জন্য আমাদেরই আগে সচেতন হতে হবে। আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর দুর্নীতির টাকাগুলো কিন্তু উন্নত বিশ্বের দিকে চলে যায়। মানে এখানকার পাচার করা টাকা ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশগুলোতে চলে যায়। এই জায়গা ধরে বলা যায়, এসব দেশের সরকারও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। কারণ, তারাই তো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর টাকা ওই দেশে গ্রহণ করতে সহযোগিতা করছে।

তারাই আবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে বড় বড় কথা বলে থাকে। আমি মনে করি, বড় আকারের যদি পরিবর্তন করতে হয় তাহলে কাঠামোগত পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আর যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন তাঁদের দুই পা শুধু দেশের মধ্যে থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে আমরা জানি, তাঁদের এক পা দেশের বাইরে থাকে। অনেকের আবার দুই দেশের নাগরিকত্ব আছে। এ রকম সিস্টেম চালু থাকলে দুর্নীতি কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হবে না।

সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আজকের পত্রিকাকেও ধন্যবাদ।

যেখানে মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে থাকে

মা কুকুর ও তার আটটি ছানা

যেথায় হাওয়ায় ভাসে ফুলের কান্না

মিসরের আরেকটি নামকাওয়াস্তে ভোট

ব্যক্তিগত গোপনীয়তা কি থাকছে

চীন-আমিরাত সামরিক সখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর-বাহির

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শিক্ষা কেন দরকার

ক্যারিয়ার নিয়ে বিভ্রান্তি

বিষ্ণু দের কাব্যচেতনার সমগ্রতা