হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

সংক্রামক উত্তেজনার প্রতিকার কোথায়

অজয় দাশগুপ্ত

জাতীয় ফল মেলা শেষ হতেই এখানে শুরু হয় লুটপাট। ছবি: আজকের পত্রিকা

উত্তেজনা একটি রোগ। এটি সংক্রামকও বটে। হঠাৎ করে আমাদের দেশ ও সমাজে উত্তেজনা এত বেড়েছে যে শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না।

আমরা বাস করি দেশের বাইরে অথচ এই দূরদেশেও সে উত্তেজনার আঁচ দেখতে পাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে, নিজেদের ভেতর অশান্তি আর গন্ডগোল যেন বেড়েই চলেছে। এর নিরসন কোথায় বা কীভাবে তা সম্ভব?

আপনারা ইতিমধ্যে দেখেছেন জাতীয় ফল উৎসবের ফলমূল লুট করে নিয়ে গেছে উত্তেজিত জনতা। এই জনতাকে এখন আমরা ডাকি মব। টাকাপয়সা, ধনদৌলতের পর এবার হাত পড়েছে ফলের ওপর। এটাকে আপনি স্বাভাবিক মনে করলে ভুল করবেন। বিজ্ঞান বলছে: উদ্বেগ, আসক্তি এবং অন্য মানসিক ব্যাধিগুলো প্রায়ই আমাদের বিপজ্জনক মানসিক অবস্থা বলেই চিহ্নিত করা হয়, বিজ্ঞানীরা এদের সাধারণত উদ্দীপনা বলে থাকেন। এই সময় হৃদ্‌যন্ত্রের গতি বেড়ে যায়, রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি।

এই অবস্থাগুলো কীভাবে মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, তা বোঝার প্রচেষ্টায় মাউন্ট সিনাইয়ের আইকান স্কুল অব মেডিসিনের বিজ্ঞানীরা একটি নতুন ধরনের গবেষণা শুরু করেছিলেন। তাঁরা দেখেছেন, মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের দুটি কেন্দ্রের মধ্যেই এমন কিছু নিউরন রয়েছে, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ গতিশীলতাকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এ ছাড়া, উত্তেজনার একটি উচ্চতর অবস্থায় কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নিউরন এই দুটি কেন্দ্রের মধ্যে একটিকে আমাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিণত করে। এর ফলে অন্য কেন্দ্রটির ওপর সিদ্ধান্ত নেওয়ার চাপ পড়ে যায়।

মাউন্ট সিনাইয়ের ফ্রিডম্যান ব্রেইন ইনস্টিটিউটের স্নায়ুবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং গবেষণার সিনিয়র লেখক পিটার রুডবেক বলেন, ‘আমাদের ফলাফলগুলো ইঙ্গিত দেয় যে মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সার্কিটগুলো শরীরের ভেতরে যা ঘটছে, তা ক্রমাগত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। এমনকি সেগুলো সংহত করার জন্য নিজেদের মধ্যে একটা যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করতে থাকে। এই কারণে আমাদের উত্তেজনার স্তরের পরিবর্তনগুলো এই সার্কিটগুলোর কাজ করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে পারে।’

তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমরা আশা করি যে এই ফলাফলগুলো গবেষকদের মস্তিষ্কের ক্ষেত্র এবং মৌলিক সেলুলার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পেতে সাহায্য করবে। এর ফলে বেশ কয়েকটি মানসিক রোগের চিকিৎসা সম্ভব হবে।’

মাথাভারী এই কথাগুলো ভালো না লাগলেও বুঝতে হবে। বুঝতেই হবে, কারণ এ ছাড়া জাতির মুক্তি অসম্ভব।

আমাদের দেশের উত্তেজিত জনগণকে বুঝতে হলে শুধু থিওরি দিয়ে বিচার করা চলবে না। কারণ, দেশের এই চুরি-ডাকাতি বা উত্তেজনার পেছনে ধারাবাহিক লুণ্ঠন লুকিয়ে আছে। আপনি একটু খেয়াল করলেই দেখবেন আমাদের সমাজ যেহেতু শ্রেণিবিভক্ত তাই উঁচু শ্রেণির মানুষজন করে লুণ্ঠন, মাঝারিরা ভাগ পায়। আর নিচের দিকে চলে চুরি। বাকি থাকল ডাকাতি। সেটি তারাই করে, যারা সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতে ডেসপারেট। যাদের আর কোনো সুযোগ নেই টাকা কামানোর।

প্রথমত, সমাজে যখন অসাম্য আর ধনী-গরিবের ভেদাভেদ প্রবল তখন বিশৃঙ্খলা স্বাভাবিক। এই বিপদকে মোকাবিলা করার জন্যই সমাজতন্ত্র বা জাকাতের নিয়ম চালু আছে। কিন্তু তার ব্যবহার আমাদের প্রভাবিত করেনি। তাহলে সমাজ টিকে আছে কীভাবে? এই জায়গাটায় ধর্মের অসীম একটা প্রভাব দেখা যায়। পরকালে বিশ্বাসী এবং ন্যায়বিচার পাবেন—এমন ধারণা যাঁরা অন্তর থেকে লালন করেন, তাঁরা ধৈর্য ধারণ করেন। একসময় প্রকৃতির নিয়মে বিচার পাবেন বা আরেক জীবনে শান্তির আশায় তাঁরা সব মেনে নেন।

কিন্তু নৈতিকতার দেয়ালও একসময় ভেঙে পড়ে। বলে রাখা ভালো, ডাকাত বা লুটেরারা যে বিচার বা শাস্তির মুখোমুখি হয় না, তা কিন্তু নয়। এখন আমরা কী দেখছি? অঢেল টাকা, জমি, সম্পত্তির মালিকেরা জান নিয়ে ভেগে কূল পাননি। কেউ কেউ বাথরুমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েও মাশুল দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের অনুশোচনা নেই।

অন্যদিকে ভয়ের কারণ হচ্ছে, এত দিন যারা লুটপাট করতে পারেনি, এখন তারা সামনে চলে এসেছে। বঞ্চিত হতাশেরা সময় ও সুযোগের ব্যবহার করছে। এটাও একধরনের উত্তেজনা। যা চাপা ছিল এখন বেরিয়ে আসছে। এমন এক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, ফলমূল পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যেতে বিবেকে বাধা লাগছে না। খেয়াল করবেন কোনো হতদরিদ্র মানুষ এখানে নেই। কারণ, তার মনে ভয় আছে। কোনো অঘটন ঘটলেই তার দিকে আঙুল উঠবে। সে বা তারা মার খাবে। এখন দেখছি মধ্যবিত্ত বা তার নিচের মানুষজন যাদের পোশাক, চেহারা বলে দেয় তারা কিনে খেতে পারে, এই তারাই এখন আগ্রাসী।

বলা বাহুল্য, বিচারহীনতা আর অনিয়ম এগুলোকে সাহস জোগায়। ২০২৩ সালে করা বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপে ভুগছে। এদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বিষণ্ন তা, উদ্বেগ বা অন্যান্য মানসিক চাপজনিত রোগে আক্রান্ত।

শুধুই কি প্রাপ্তবয়স্করাই? না এই তালিকায় রয়েছে কিশোর-কিশোরীরাও। বিএমজি সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে জানা যায়, বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর-কিশোরীদের ৭৩.৫ শতাংশের মাঝেই মানসিক চাপসংক্রান্ত লক্ষণ দেখা গেছে। আর মানসিক চাপের উপসর্গ মিলেছে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে। আজকে এরাই হয়তো নেমে গেছে মাঠে।

যে কথা বলছিলাম, বীজতলা হয়ে গেলে বা প্রস্তুত থাকলে গাছ তো গজাবেই। মানুষ যেকোনো পরিবর্তন চায় শান্তির জন্য। সে শান্তি যদি না থাকে বা অশান্তি যদি বাড়তেই থাকে জনগণ কি ধৈর্য রাখতে পারে? ক্রমাগত আক্রান্ত হতে হতে একসময় রুখে দাঁড়ায়। এর প্রমাণ বহুবার দেখেছি আমরা। তবু কেউ পাঠ নেয় না। আরেকটা কথা না বললেই নয়; এইসব খবর এবং ছবি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের দেশের মানসম্মান, ভাবমূর্তি পড়ে হুমকির মুখে। সবাই এসব জানেন কিন্তু মানেন না।

সে কারণেই এখন দেশের বাইরেও চলছে উত্তেজনা আর অবিশ্বাসের সময়কাল। আশু এর সমাধান আর প্রতিরোধ করা না হলে বাংলাদেশের জনগণের জীবনে শান্তি আসবে না। তখন সব পরিবর্তনই ব্যাপক প্রশ্নের মুখে পড়বে।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

এভাবে চলতে থাকলে কি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে

প্রবীণ জীবনে বন্ধুত্বের গুরুত্ব

সংকট, সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ

গণতন্ত্রের সন্ধিক্ষণ: তারেক রহমানের দেশে ফেরা

কেন পুড়িয়ে মারার মধ্যযুগীয় বর্বরতা

তারেকের প্রত্যাবর্তন: রাজনৈতিক ভবিষ্যতের এক মাহেন্দ্রক্ষণ

বিশ্বজুড়েই কেন গণমাধ্যম আক্রান্ত

সাইবার যুদ্ধ ও নজরদারি প্রযুক্তি: বৈশ্বিক নিরাপত্তা কোন পথে

মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে তুরস্কের নয়া ভূমিকা

রাষ্ট্রের মালিকানা এল না জনগণের হাতে