বিশ্বে এখন সংকট ও সংঘাত চলছে। সংকট থেকে সংঘাত, নাকি সংঘাতের কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। অনেকটা ডিম আগে নাকি মুরগি আগের মতো বিষয়। তবে সংকটের পাকানো দড়ির দুই প্রান্ত ধরে টানাটানি করতে থাকা পক্ষগুলো যে এ ক্ষেত্রে একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, সেটি বুঝতে সমস্যা হয় না। কোকিলের ডিমে যেমন কাক তা দেয়, তেমনি গ্রামের এক মোড়ল সংকট সৃষ্টি করলে আরেকজন তাকে নিজ দায়িত্বে সংঘাতে পৌঁছে দেন!
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই মূলত বিশ্বায়িত বিশ্বে বা গ্রামে মোড়ল হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল। এর পেছনে কোনো না কোনো পক্ষে নিরাপত্তাহীনতার বোধ ছিল। ধরুন, জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটেনি। পশ্চিমা বিশ্ব, বিশেষ করে মার্কিনপন্থী বিশ্বনাগরিকেরা বলে বসতে পারেন, ‘তবে কি বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতো? এখনো চলত।’ অর্থাৎ তাদের মূল বক্তব্যই হলো, মার্কিন সেই পরমাণু হামলাই বিশ্বযুদ্ধের ইতি টেনেছে। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ কয়েক ঘণ্টায় মেরে যে যুদ্ধ শেষ হয়, সেটি এক অর্থে কি ওই ধ্বংসযজ্ঞকেই সমর্থন করে না? তখন মনে হতেই পারে, এক নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে আরও নির্মম মাত্রায় পৌঁছাতেই হবে। কারণ তৈরি উদাহরণ আছেই যে, অবিচারই অবিচারের হন্তারক! এসব থেকেই হয়তো বিষে বিষক্ষয় প্রবাদের উৎপত্তি।
পরমাণু বোমার সফল প্রয়োগ ঠেকানো গেলে হয়তো এবারের ইউক্রেন সংকটেও আশঙ্কার পাশাপাশি একটা আশা থাকত। ইউক্রেনে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভ্লাদিমির পুতিন কারও ভাষায় সামরিক অভিযান, কারও ভাষায় আগ্রাসন শুরু করার পর থেকেই পরমাণু বোমা ব্যবহারের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষকই বলছেন যে, পুতিন পারমাণবিক বোমা ছোড়ার বোতাম টিপে দিতেই পারেন। কথা হলো, এই বোমা যে জনবহুল স্থানে ব্যবহার করা যায় এবং তা ব্যবহারের পরও বীরদর্পে বিশ্বজুড়ে ছড়ি ঘোরানো যায়, সেই পথ প্রথমে দেখিয়েছে কে? যদি সেই উদাহরণ না থাকত, তবে একধরনের নৈতিক বাধা বর্তমান থাকত, যা অতিক্রমের আগে যেকোনো পরাশক্তি কয়েক দফা ভাবত। কিন্তু সেই বাধা নিজে ডিঙিয়ে অন্যকে বারংবার নিষেধ করা কি নিজে পেটপুরে মিষ্টি খেয়ে অন্যকে ডায়াবেটিসের ভয় দেখানোর মতো নয়?
ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পক্ষের পশ্চিমা দেশগুলো অনেক দিন ধরেই গলা ফাটাচ্ছে ‘আগ্রাসন’ নিয়ে। সেই আগ্রাসন যখন হলোই, তখন ভলোদিমির জেলেনস্কির পাশে তারা কি ত্বরিতগতিতে রসদ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল? না, দাঁড়ায়নি। তাই জেলেনস্কিকে দুঃখ করে বলতে হয়েছিল, নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার চেয়ে গোলাবারুদ ও অস্ত্র দিলে ভালো হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা ভালো করেই জানত, ইউক্রেনকে ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য করতে গেলে উষ্ণ প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না পুতিন। হয়তো শীতলতা হিমাঙ্কের কতটা নিচে নামবে, সেই হিসাবটাই কষা হয়নি। তবে কি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা চালানোর জন্যই ইউক্রেনকে ন্যাটো-ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছিল, ‘এসো, আমার ঘরে এসো?’ দাওয়াত দিয়ে যদি অতিথিকে চা-বিস্কুট খাওয়ানোর সামর্থ্য না-ই থাকে, তবে ডাকা কেন?
ইউক্রেন ইস্যুতে হালনাগাদ আশঙ্কা হলো, পুতিন ইউরোপে তেল ও গ্যাসের সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারেন। কারণ রাশিয়ার ওপর যে পরিমাণ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে, তাতে একটা জুতসই জবাব না দিলে যে মান থাকে না! ফলে পুরো বিশ্ববাজারেই অস্থিরতা, এমনকি নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে, যদিও রাশিয়া থেকে ক্রুড অয়েল আমদানির তালিকায় ঢের পেছনে মার্কিনিরা। অর্থাৎ, ক্ষতি যতটা না যুক্তরাষ্ট্রের হবে, তার চেয়ে বেশি হবে অন্যদের। এ ধরনের সংকটেই আবার রাজনৈতিক সুবিধা বেশি পাওয়া যায়। বর্তমান সংকটের হিসাবই হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে মানের দিক থেকে রুবল নিঃস্ব হয়ে গেলেও পুতিনের কিছু যায়-আসে না। কারণ তাঁর উদ্দেশ্য মুকুট রক্ষায় ‘অমর’ হওয়া। আর বাইডেনের উদ্দেশ্য হয়তো মেক আমেরিকা ‘ডমিন্যান্ট’ অ্যাগেইন!
লেখক: সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা