হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

করোনা মোকাবিলায় পদক্ষেপ কে নিচ্ছে

ফজলুল কবির

করোনায় আজও সারা দেশে ২৪ ঘণ্টায় ২৬৪ জন মারা যাওয়ার খবর এসেছে। সংক্রমণ পরিস্থিতিও ভালো নয়। গত বেশ কিছু দিন ধরেই দেশে দিনে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা দুই শতাধিক। পরিস্থিতি ভালো নয়—এটা সবাই মানছেন। স্বাভাবিকভাবেই করোনা মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দিকেই সবাই তাকিয়ে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে সমন্বয়হীনতা চোখে পড়ছে, তা ভয়াবহ। 

এ সংকটকালে সরকারের উচ্চমহল থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। করোনা টিকাদান কর্মসূচির পরিসর বেড়েছে। টিকা উৎপাদনকারী বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা আনার চেষ্টা চলছে। সাফল্যও আসছে। শহর ছাড়িয়ে গ্রাম পর্যায়ে টিকা দেওয়া চলছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এই টিকাদানে বাংলাদেশ তার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে বেশ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে। টিকার জোগানের সংকটটি কাটিয়ে ওঠা গেলে এটি নিশ্চয় আরও বেগবান হবে। 

এবার আসা যাক করোনা মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃত সংক্রমণ প্রতিরোধের বিষয়টির দিকে। বিশ্বের যেসব দেশে টিকা কার্যক্রম বেশ সফল, সবগুলো দেশই সংক্রমণ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের দেওয়া পরামর্শ মেনে চলছে। দু–একটি দেশ মাস্ক পরায় বাধ্যবাধকতা শিথিল করলেও পরে ডেলটা ধরনের সংক্রমণ বাড়ায় তা আবার ফিরিয়ে এনেছে। একইভাবে জনসমাগমে আরোপিত বিধিনিষেধ নতুন করে আরোপ হচ্ছে আবার। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। 

বাংলাদেশ যেন অনেকটাই প্রকৃত পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নয়, দেখাদেখি নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। অর্থাৎ, লকডাউন দিতে হয়, তাই দেওয়া, ‘স্বাস্থ্যবিধি’ শব্দটি উচ্চারণ করতে হয়, তাই করা। ফলে কখন, কী কারণে বিধিনিষেধ আরোপ হচ্ছে, কখন তা শিথিল হচ্ছে বা কঠোর কিংবা কঠোরতম হচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না। দেশে দুই শতাধিক দৈনিক মৃত্যু হলেও এবং এ মৃত্যুহার কমার কোনো অদূর সংকেত দেখা না গেলেও হঠাৎ করেই বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হলো। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই শিথিল করার যুক্তিটি কিছুটা বোঝা গেলেও গণপরিবহনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তটি স্পষ্ট নয়।

গত ৮ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগামীকাল বুধবার থেকে রাস্তায় গণপরিবহন চলবে। তবে মোট সংখ্যার অর্ধেক। অর্থাৎ, একদিনে মোট গণপরিবহনের সংখ্যার অর্ধেক রাস্তায় বেরোতে পারবে। আর রাস্তায় বেরোনো প্রতিটি পরিবহন পূর্ণ যাত্রী নিয়ে চলবে। অর্থাৎ, ঢাকা শহরে যদি ১০০টি বাস থাকে, তবে রাস্তায় বেরোতে পারবে ৫০টি। আর বাসগুলোর আসনসংখ্যা যদি হয় ৫০, তবে তারা ৫০ জন করেই যাত্রী পরিবহন করতে পারবে; এর বেশি নয়। সঙ্গে ১৪ ঘণ্টা রেস্তোরাঁ ও ১০ ঘণ্টা শপিংমল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে রেস্তোরাঁয় অর্ধেক আসনে গ্রাহক বসতে পারবেন। আর শপিংমলের ক্ষেত্রে এমন কোনো নির্দেশনা নেই। তবে সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে চলার কঠোর নির্দেশ এসেছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা এই প্রজ্ঞাপন বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। পূর্ণ যাত্রী নিয়ে অর্ধেক গণপরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত আসলে কাকে করোনা থেকে সুরক্ষা দেবে, যাত্রীবেশে মানুষকে নাকি গণপরিবহনগুলোকে? একই ব্যক্তি পাশের সিটে অন্যের সঙ্গে গা ঘেঁষে থাকলেও করোনা সংক্রমণ হবে না, কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসলে হবেন—এমন কোনো গোপন সংক্রমণ পন্থা বিষয়ে কোনো কিছু হঠাৎ জানা গেছে কি? শপিংমলগুলো যে ১০ ঘণ্টা খোলা থাকবে, সে সময় করোনাভাইরাসটি কী করবে? তারা কি কথা দিয়েছে এই সময়ে শপিংমলে তারা যাবে না, শুধু মাস্ক পরা থাকলেই হবে? নাকি পকেটে বা হাতে স্যানিটাইজারের শিশি দেখলেই তারা কাতারে কাতারে আত্মহত্যা করবে? 

একই প্রজ্ঞাপনে একবার পাশাপাশি লোক বসায় সংকট নেই, আরেকবার সমস্যা আছে—এই বৈপরীত্য কী কারণে? এই সব প্রশ্ন যখন মাথায় ঘুরছে, তখন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের করেছেন মোক্ষম প্রশ্নটি। তিনি বলছেন, ‘অর্ধেক গাড়ি চলবে, আর অর্ধেক চলবে না—এই নিশ্চয়তা কে দেবে?’ খুবই গুরুতর ও জরুরি প্রশ্ন। একই সঙ্গে এও জানিয়েছেন, এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা হয়নি। তিনি তাঁর বক্তব্যে এ নিয়ে কিছুটা উষ্মাও প্রকাশ করেছেন। এবং এটাই স্বাভাবিক। 

ওবায়দুল কাদেরের তোলা এই প্রশ্নের উত্তর আসার বদলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানালেন আরেক অদ্ভুত তথ্য। তিনি বললেন, এমন সিদ্ধান্ত তাঁরা নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে। এই একটি তথ্য সবার চোয়াল ঝুলিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

করোনা গোটা বিশ্বেই একটি স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এই সংকট মুখ্যত স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট। দীর্ঘ এই মহামারির কারণে আরও নানা ক্ষেত্রেই সংকট হচ্ছে। এর একটি আইন–শৃঙ্খলা। এবং এই আইন–শৃঙ্খলা সংকটের জন্য দায়ী অর্থনৈতিক কারণ। দেশে করোনাকালে দারিদ্র্য বাড়ছে। নতুন করে বহু মানুষ দরিদ্রের স্তরে নেমে যাচ্ছেন। ব্যবসায়ীরা বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা মহা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক এই সংকট বাড়িয়ে দিচ্ছে চুরি–ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। বাড়ছে বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম ইত্যাদি। শিক্ষা খাত একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। উৎপাদন খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এই সবই মূল ক্ষেত্র স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত। 

এই সব বিষয়কে মাথায় রেখে গত বছরই করোনা মোকাবিলায় একটি জাতীয় টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গঠিত অনুরূপ অঙ্গগুলোর মূল কাজ হলো দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে করোনা মোকাবিলায় একটি যথাযথ পরামর্শ দেওয়া। এ জন্য এ ধরনের কমিটিতে এই মহামারির প্রভাব পড়ছে বা পড়তে পারে এমন প্রতিটি ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের রাখা হয়। সঙ্গে থাকেন প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা। ব্যাপক তর্কবিতর্কের পর একটি যথাযথ সিদ্ধান্ত গ্রহণই এর লক্ষ্য থাকে। তারাই করোনা মোকাবিলায় কী পদক্ষেপ, কেন ও কীভাবে নেওয়া হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দেন। সরকার বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় তাতে কিছু অদল–বদল করে একটি সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা জানানোর কথা। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মহামারি, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বিশেষ গুরুত্ব পান।

কিন্তু বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এমনটা দেখা যায়নি। কে কীভাবে করোনা মোকাবিলায় করণীয় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা নিয়ে জনমনে বিস্তর প্রশ্ন রয়েছে। এবার অবশ্য তার একটি জবাব মন্ত্রিপরিষদ সচিব দিলেন। জানালেন, আইন–শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে হালের এই সিদ্ধান্তটি হয়েছে। যে গণপরিবহন চলাচল নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে, তা নিয়ে এমনকি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও আলাপ হয়নি। বিষয়টি এক কথায় ভয়াবহ ও খামখেয়ালিপূর্ণ।

ফজলুল কবির: লেখক ও সাংবাদিক
ই–মেইল: fazlul.kabir@ajkerpatrika.com

এবার নির্বাচনের দিকে চোখ থাকবে সবার

আন্তর্জাতিক মূল্যহ্রাস ভোক্তার কাছে পৌঁছায় না কেন

ভারতজুড়েই কি ফুটবে পদ্মফুল

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

সমুদ্রস্তরের উত্থান ও দ্বীপরাষ্ট্রের নিরাপত্তা

সংকটেও ভালো থাকুক বাংলাদেশ

মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা নিয়ে কথা

পাঠকের লেখা: বিজয় অর্জনের গৌরব

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের কি বিচ্ছেদ হলো

একাত্তরে সামষ্টিক মুক্তি আসেনি