প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটি ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা।
আজ সোমবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত ‘মুক্ত স্বদেশে জাতির পিতা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। বিটিভির শহীদ মনিরুল আলম মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘১০ জানুয়ারির ভাষণ ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা। এই ভাষণটা ছিল স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো কীভাবে কী হবে, কীভাবে চলবে, কোন আদর্শে চলবে—সেটাই তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন। একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা (বঙ্গবন্ধুর) ভাষণে আমরা পেয়েছি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত-সমৃদ্ধ ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তোলার প্রত্যয় তিনি ব্যক্ত করেছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু এই দেশ স্বাধীন করেছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশকে তিনি স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে একেবারে তৃণমূলের মানুষের ভোট, ভাতের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পদক্ষেপ (যখন) নিলেন, তখনই কিন্তু ১৫ আগস্টের আঘাতটা এল। এটা শুধু রাষ্ট্রপতিকে হত্যা না, একটি স্বাধীন দেশের আদর্শ ও চেতনাকে হত্যা করা। সেটা সবাই দেখতে পাবেন পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতা চালিয়েছিল, তাদের কর্মকাণ্ডে।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করাই বর্তমান সরকারের লক্ষ্য বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘যতটুকু পারি জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে, বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের ভাগ্যটা পরিবর্তন করে দিয়ে যাব। আজকে যে অগ্রগতি হয়েছে, সেটা ধরে রেখে যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টা হয়তো সশরীরে বঙ্গবন্ধু আমাদের পাশে ছিলেন না। কিন্তু বাঙালির হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে যে প্রেরণা দিয়ে গিয়েছিলেন সেটাকে ধারণ করেই (ছিল তারা)। তাঁর দীর্ঘজীবনের সংগ্রামের ফসল হিসেবেই আমরা বিজয় অর্জন করি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে, জাতির পিতা (তখন) স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন, যেটা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তখনকার ইপিআর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিল। সাথে সাথে পাক হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। পরের দিন ২৬ মার্চ আবার আমাদের বাড়িতে আক্রমণ করে। পাশের বাড়ি থেকে মা এবং রাসেলকে তারা উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরে আমার মা, রাসেল, রেহানা, কামাল, আমি এবং আব্বার ফুফাতো ভাইকে গ্রেপ্তার করে। ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোড (বর্তমানে ৯/এ), ২৬ নম্বর বাড়িতে নিয়ে আমাদের বন্দী করে রাখে। আমাদের ৩২ নম্বরের বাসায় রাখেনি। সেই বাসায় ৯ মাস ধরে লুটপাট করে।
‘১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু ১৮ নম্বর সড়কের একতলা বাড়িতে আমার মা বন্দী ছিলেন। আমরা কিন্তু মুক্ত হইনি। আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম ১৭ ডিসেম্বর।’
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘দীর্ঘ ৯ মাস আমরা জানতাম না আমার বাবা বেঁচে আছেন কি-না। জানার কোনো সুযোগ ছিল না। এরপর ৮ জানুয়ারি প্রথম যখন টেলিফোনটা পেলাম, আমার মা কথা বলতে পারছিলেন না। ওই শুধু “কেমন আছ? ভালো আছ? কবে আসবে?”—এইটুকু বলতে পেরেছিলেন। আমরা সবাই একে একে কথা বলি। সেদিনটি যে আমাদের জন্য কী রকম ছিল, তা সবাইকে ভাষায় বোঝাতে পারব না।’
বঙ্গবন্ধু মৃত্যুকে ভয় করেননি, জয় করেছিলেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানি কারাগারে যে নির্যাতন তাঁর ওপরে হয়েছিল। আমরা কিন্তু জানতে পারিনি। জিজ্ঞাসা করেও জানতে পারিনি। হয়তো আমাদের কাছে বলবেন না। রেহানা ছোট ছিল, সে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল। উত্তরে তিনি শুধু একটা কথাই বলেছিলেন—“ওইটা আমি বলতে চাই না। তোরা সহ্য করতে পারবি না।” এই কথা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, পাকিস্তানি কারাগারে কী দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্যে তাঁকে থাকতে হয়েছিল।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মহিউদ্দিন আহমেদ, জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানা রচিত দুটি কবিতা আবৃত্তি করেন সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। আলোচনা সভার পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করেন।
এদিকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে সোমবার সকাল ৭টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে স্থাপিত জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। পরে তাঁরা মোনাজাতে অংশ নেন।