সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই হয়ে যেতে পারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এর পরেই পুরোদমে ভোটের প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়বে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত দলগুলোর মধ্যে ভোটের মেরুকরণে তেমন কোনো বড় নড়চড় চোখে পড়ছে না। ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পাকা করার কৌশলে ভোটের আগ দিয়ে জোট গড়ার আলাপ বরাবরের মতো এবারও ছিল শুরু থেকে। কিন্তু সেই আলাপ যেন কোনো পরিণতিতে গড়াচ্ছে না।
যদিও সমন্বিতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা এখনো বলে যাচ্ছে ছোট কয়েকটি দল। কিন্তু প্রথাগত নির্বাচনী জোটের ঘোষণা এখনো আসেনি কারও পক্ষ থেকে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)—এই প্রধান তিন শক্তি এবং তাদের মিত্র দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, নির্বাচনী জোট বলতে যা বোঝায়, তা যে হচ্ছে না, সেটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগপর্যন্ত ছোট ছোট অনেক দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন চালিয়ে এসেছে বিএনপি। ভোটের আলাপ শুরু হওয়ার পর থেকে দলটি তাই রাজপথের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং জয়ী হলে সমন্বিতভাবে সরকার গঠনের কথা বলে আসছে। এখনো ওই অবস্থানে থেকেই মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দলটি।
বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, শরিকদের অবদানকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে বিএনপি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে সবার আগে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার বিষয়কে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। দলের ভেতরে ও বাইরে মিত্রদের সঙ্গে আসন সমঝোতার ক্ষেত্রেও বিষয়টি সামনে আনছেন তাঁরা। নীতিনির্ধারকদের ভাষ্য অনুযায়ী, মিত্রদের সঙ্গে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, নির্বাচনের পরেও এই সম্পর্ক অটুট থাকবে এবং সবাইকে নিয়েও সরকার গঠন করা হবে। কিন্তু তার আগে দরকার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া। কারণ, নির্বাচনে বিজয়ী না হলে সব চেষ্টাই বৃথা হয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যদিও এরই মধ্যে নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির মনোনয়ন ঘিরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে শরিকদের অনেকের মধ্যে। ২৭২টি আসনে বিএনপির ঘোষিত সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা নিয়ে এরই মধ্যে আপত্তি তুলেছে তারা।
গত শুক্রবার বিএনপির অন্যতম মিত্র ১২ দলীয় জোট সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছে, শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে বিএনপির দুই ধাপে সংসদীয় আসনের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। জোটের নেতারা বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শরিকদের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচন এবং সরকার গঠনের যে দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ২৭২টি আসনে মনোনয়ন ঘোষণার মাধ্যমে তার বরখেলাপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় বিষয়ে আগামীকাল সোমবার সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরার কথা বলেছেন জোটের নেতারা।
শরিকদের এসব অভিযোগের বিপরীতে বাস্তবতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। শরিক দলগুলোকে কতটি আসন ছাড়া হবে, তার আগে দেখছেন বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু। এ ক্ষেত্রে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বাধ্যবাধকতা শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার আলোচনায় আরও বেশি বিপাকে ফেলেছে বিএনপিকে। নিবন্ধিত শরিক দলের প্রার্থীরা তাঁদের নিজ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হতে পারবেন—এমন ভরসা রাখতে পারছে না বিএনপি।
নির্বাচনী জোট নিয়ে শরিকদের সঙ্গে আলোচনা চলছে জানিয়ে গতকাল শনিবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যাঁরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলেন, তাঁদের অনেক এলাকা নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। এখনো ২৮টা আসন তো বাকি আছে। জোটের আলোচনা তো এখনো শেষ হয়নি।’
আওয়ামী লীগবিহীন ভোটের মাঠে নতুন বাস্তবতায় এবার বিএনপির প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে সামনে এসেছে জামায়াতে ইসলামী। তাদের নেতৃত্বে ইতিমধ্যে আটটি দল একযোগে সক্রিয় মাঠের আন্দোলনে। জামায়াতের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ আটটি ইসলামপন্থী দল থাকলেও ভোটের জোট বা নির্বাচনে আসন সমঝোতার ঘোষণা এখনো আসেনি তাদের দিক থেকে।
জামায়াতের একাধিক সূত্র বলছে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগেই শরিকদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রতিটি আসনের চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশিত হবে। সমন্বিত কৌশলে ভোটযুদ্ধে লড়ার পরিকল্পনা চলছে।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই আসন সমঝোতার প্রক্রিয়া শেষ হতে পারে জানিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা তো আগেই নিজেদের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছি। এখন যেহেতু অন্য কয়েকটি দলের সঙ্গে সমঝোতা করতে হচ্ছে...এখানে আলাপ আলোচনার অনেক বিষয় আছে।’
এবার বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির কোনো জোট হয় কি না, বড় করে সেদিকেই শুরু থেকে সবার নজর। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত নেই; বরং সংস্কারের পক্ষে থাকা মধ্যপন্থী দলগুলোর সঙ্গে জোটের আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এনসিপি। তৃতীয় শক্তি বা তৃতীয় জোট গঠন করে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার প্রশ্নে শক্তিশালী অবস্থানে থাকতে চাইছে বলে জানিয়েছেন এনসিপির একাধিক নেতা।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এবি পার্টি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ মধ্যমপন্থী রাজনীতি এবং সংস্কারের পক্ষে থাকা দলগুলোর সমন্বয়ে জোটের বিষয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে।
তবে জোটের বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী বাছাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করব। তবে জোট নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’
এনসিপির একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, জোট নিয়ে এনসিপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আটকে আছে দুই ছাত্র উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও আসিফ মাহমুদের ওপর। এর মধ্যে একজন উপদেষ্টা মনে করেন, এনসিপি বিএনপির সঙ্গে জোট না করে এককভাবে নির্বাচন করলেও সুবিধাভোগী হবে জামায়াতে ইসলামী। আর জোট করলে পুরো সুবিধাই জামায়াত পাবে। এ ক্ষেত্রে এনসিপির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়বে। দলটি রাজনৈতিক মাঠে অবস্থান তৈরি করতে পারবে না বলেও মনে করেন ওই উপদেষ্টা। যে কারণে দলটিতে থাকা দুই উপদেষ্টার অনুসারীরা এনসিপিকে বিএনপির দিকে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে দলটির নেতাদের একটা অংশ জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে আগ্রহী। জোট নিয়ে নেতাদের মতভেদের কারণে এনসিপির মধ্যে বিভক্তি চলছে বলে জানা গেছে। দুই উপদেষ্টা এনসিপিতে যোগ দেবেন কি না, তা নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘তাঁদের (দুই উপদেষ্টা) জন্য দলের দরজা খোলাই আছে। তাঁরা চাইলেই এনসিপিতে যোগ দিতে পারেন এবং নির্বাচন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আইনি বিধিনিষেধ নেই।’
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের শরিক হিসেবে গত তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হয়েছিল জাতীয় পার্টি। দলটিকে নিষিদ্ধের সঙ্গে ভোটে অযোগ্য ঘোষণার দাবিতে রাজপথে একাধিক দল আন্দোলনও করেছিল। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচন করা জাপার নিজস্ব সিদ্ধান্ত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন দেখা দেয়। আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে একটি অংশ সম্মেলন করে নতুন কমিটি দিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে এরই মধ্যে। দলটি আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বোধীন আওয়ামী লীগের শরিক জাতীয় পার্টির (জেপি) সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। আগামীকাল সোমবার জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক জোট নামে নতুন জোটের ঘোষণা দিতে পারেন তাঁরা। এ জোটে নতুন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল জনতা পার্টিসহ আরও ১৬টি রাজনৈতিক দল রয়েছে বলে জানা গেছে। তারা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে।
অন্যদিকে গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মূল অংশ এখনো নির্বাচনী জোট তৈরির বিষয়ে আলোচনা শুরু করেনি। তবে কোনো দল তাদের আমন্ত্রণ জানালে জোট করতে আগ্রহী তাঁরা। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে জোট গঠনে জাপা উদ্যোগ নেবে বলে জানা গেছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নির্বাচন করলে কোনো একটা জোট হতেই পারে। জোট গঠন নিয়ে আমরা কারও সঙ্গে আলোচনা শুরু করেনি। তবে আমাদের ভোটব্যাংক রয়েছে, তাই অনেকে আমাদের জোটে নিতে আগ্রহী হবে। কারণ, আমাদের ভোট অনেক আসনে ফলাফল নির্ধারণ করবে।’
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বামপন্থী, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক ধারার ৯টি দল নিয়ে নতুন জোট ‘গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট’ করার ঘোষণা দিয়েছে বামপন্থী দলগুলো। দলগুলো হলো—বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, বাসদ (মার্ক্সবাদী), বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল—বাসদ (মাহবুব) ও সোনার বাংলা পার্টি। গতকাল শনিবার এক রাজনৈতিক কনভেনশনের মাধ্যমে এই নতুন জোটের ঘোষণা করেন তাঁরা। নেতারা বলছেন, জোটের কলেবর বাড়াতে ঐক্য ন্যাপ, গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন, নয়া গণতান্ত্রিক গণমোর্চাসহ আরও কয়েকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
এই জোটের অন্যতম শরিক দল বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ কাফি রতন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে যুক্তফ্রন্ট ঘোষণা করেছি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বামপন্থী গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গেও আলোচনা চলমান। একই সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে একটি জনতার সনদ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছি।’