ঢাকা: গাদাগাদি করে যাত্রী নিয়ে চলছে বাস। খাবারের হোটেল-রেস্তোরাঁয় ভিড়। হাট-বাজার, শপিংমলে সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। বাড়ির বাইরে বের হয়ে মাস্ক ব্যবহার করেন না অনেকে। লকডাউনের মধ্যে এসব দেখারও যেন কেউ নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া সবকিছু স্বাভাবিকভাবে চললেও আগামী ৬ জুন পর্যন্ত মানুষের চলাচলে বিধিনিষেধ বা লকডাউন দিয়ে রেখেছে সরকার। লকডাউন বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। তবে বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন লকডাউন আর কার্যকর নেই। এভাবে লকডাউন দিয়ে তেমন কোনো লাভও হচ্ছে না। সারা দেশে এভাবে লকডাউন না দিয়ে সীমান্তবর্তী নয় জেলায় করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। ওই বছরের ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিনের লকডাউন দেওয়া হয়েছিল। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে এবার গত ৫ এপ্রিল থেকে লকডাউন চলছে।
করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সীমান্তবর্তী জেলা ও অধিক সংক্রমিত এলাকায় লকডাউনের সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। উচ্চ সংক্রমিত এলাকা থেকে আন্তজেলা গণপরিবহন বন্ধ রাখতেও পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট এলাকায় করোনা সংক্রমণের উচ্চহার দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া আরও কিছু জেলায় উচ্চ সংক্রমণ হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ভারতীয় ধরনের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব শেখ রফিকুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, লকডাউন বাস্তবায়নে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া আছে। এদের পাশাপাশি পুলিশও লকডাউন কার্যকরে কাজ করছে।
মিরপুর এক নম্বর সেক্টর থেকে প্রতিদিন মতিঝিল গিয়ে অফিস করেন আব্দুল মালেক খান। বুধবার আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, সকালে অফিসে আসার সময় বাসের সব সিটেই যাত্রী নেওয়া হয়। অনেক সময় রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা হচ্ছে, প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয় না।
ফরিদুর রহমান নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা প্রতিদিন মাতুয়াইল থেকে বাসে করে গুলিস্তানে তাঁর কর্মস্থলে আসেন। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, কিছু কিছু সিটিংস সার্ভিস বাস এখনো এক সিট ফাঁকা রেখে চলছে। এক সিট ফাঁকা রাখলেও ওই বাসেই ১০-১২ জন করে যাত্রীকে দাঁড় করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। ফলে সামাজিক দূরত্ব মানা যাচ্ছে না, উল্টো দ্বিগুণ ভাড়া দিতে হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমদ আজ বুধবার আজকের পত্রিকাকে বলেন, এভাবে লকডাউন / বিধিনিষেধ দিয়ে কোনো লাভ নেই। বিধিনিষেধ আর কার্যকর নেই। লকডাউন নেই বলতে পারেন। কিছু অফিস আদালত বন্ধ রাখা হলেও সেখানেও এখন অনেকেই যাচ্ছেন।
‘এখন সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বাড়ছে সেখানে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। স্থানীয়ভাবে এসব এলাকার লকডাউন করতে হবে। সেখান থেকে যেন সংক্রমণ আর না ছড়ায়।’
‘সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ কমাতে পারলে অন্য এলাকায় তা আর ছড়াবে না। এখনই এটাই করতে হবে। নয়টি জেলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ কার্যক্রম দরকার।’
মহামারির মধ্যে মানুষ বিধিনিষেধগুলো ঠিকমতো না মানলেও এর মধ্য দিয়েও কিছুটা লাভ হচ্ছে বলে দাবি করেছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন। আজকের পত্রিকাকে বলেন, করোনা সংক্রমণ কমাতে বিধিনিষেধ চলছে। যত দিন করোনা থাকবে তত দিন বিধিনিষেধও রাখতে হবে। মাস্ক পরা, দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলা-এসব তো বিধিনিষেধের মধ্যেই পরে।
‘এটা ঠিক সবকিছুই চলছে। কোনো না কোনো সময়তো সবকিছু ছাড়তেই হবে। তবে বিধিনিষেধ থাকবে। এই বিধিনিষেধের কারণেই এখনো কমিউনিটি সেন্টার, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সমাবেশ বন্ধ আছে। পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ আছে।’
মুশতাক হোসেন বলেন, লকডাউন দিলে সবকিছু বন্ধ রাখতে হবে। এখন লকডাউন নেই। ১৪ এপ্রিল থেকে দুই সপ্তাহ লকডাউন ছিল। মানুষকে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছায় ঘরে থাকতে হবে। লকডাউন ঘোষণা করা হলে আইন মানাতে সহজ হয়। আদর্শ অবস্থা হলো যতক্ষণ পর্যন্ত সংক্রমণ কমে না আসে সবকিছু বন্ধ করে রাখা। কিন্তু সেটা তো আমাদের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কারণ ঘরে বসে থাকলে যারা না খেয়ে মারা যাবেন তাদের কি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সাপোর্ট দেওয়া যাবে? তাই বাধ্য হয়েই অনেক কিছু শিথিল করতে হচ্ছে। করোনা থেকে বাঁচানোর কথা বলে না খেয়ে মানুষকে মারতে পারেন না। সরকার যদি সবাইকে খাবার দিতে না পারে ঘরে বসে থাকতে বলতে পারে না। যতটুকু না করলেই না এখন ততটুকু করা হচ্ছে। চীনের উহানে যেটা করা হয়েছে আমাদের পক্ষে তা সম্ভব না।
ঢিলেঢালা এই বিধিনিষেধের মধ্যেও ফল পাওয়া যাচ্ছে জানিয়ে মুশতাক বলেন, সংক্রমণ কমে গেছে, লাভ হচ্ছে। সংক্রমণের মাত্রা দেখে কখনো বিধিনিষেধ ব্যাপক করতে হবে, কখনো কমাতে হবে। কারণ জীবন চালাতে হবে। সংক্রমণ বাড়ার পরেও বিধিনিষেধ শিথিল করা হলে সেটা সবার জন্য বিপজ্জনক হবে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এখন সংক্রমণ বেশি। তাই ওই সব জেলায় বিধিনিষেধ আরও ব্যাপক করতে হবে। কারণ সংক্রমণ বাড়লে তীব্র গতিতে তা ছড়াতে থাকবে, মৃত্যুর হার বাড়বে। যেখানে সংক্রমণ বেশি সেখানে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।