দেশে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে খুন হয়েছে ৩ হাজার ২৩০ জন। সেই হিসাবে প্রতিদিন খুন হচ্ছে প্রায় ১১ জন। সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ঢাকায় এবং কম বরিশাল বিভাগে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের খুনোখুনির এই সংখ্যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেশি; যা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত করে। পুলিশ বলছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তবে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিছু এলাকায় যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, অপরাধের বিভিন্ন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, প্রকাশ্যে হত্যাসহ নানাভাবে নৃশংস খুনের ঘটনা বেড়ে চলছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বিদ্যমান সমন্বয়হীনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অসহযোগিতা, অভিযুক্ত বা অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বা অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ বা গ্রহণে বিলম্ব অপরাধীদের নানাভাবে সহিংস করছে।
ঢাকার কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এসব হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসীর হাত রয়েছে। আর এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাজনৈতিক কোন্দল, অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, মাদক কারবার, পারিবারিক কলহসহ নানা কারণ রয়েছে।
১৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর মিরপুর ১২ নম্বর সেকশনের সি ব্লকে একটি হার্ডওয়্যার অ্যান্ড স্যানিটারির দোকানে বসে ছিলেন পল্লবী থানা জাতীয়তাবাদী যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়া (৫০)। কয়েকজন অস্ত্রধারী দোকানে ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
এর আগে ১০ নভেম্বর পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনে তারিক সাইফ মামুন নামের এক শীর্ষ সন্ত্রাসীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। একসময় ঢাকার ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার আতঙ্ক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগী মামুন। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে মামুনকে হত্যা করা হয়।
চলতি বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে পিটিয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। গত ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ১৬ নম্বর সড়কের মাথায় সাঁকোর পাড় এলাকায় দুই দফায় চার তরুণকে পেটানো হয়। এ সময় মারধরের শিকার হয়ে মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ নিহত হন।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর—এই ১০ মাসে খুন হয়েছে ৩ হাজার ২৩০ জন মানুষ। ২০২৪ সালের একই সময়ে খুন হয়েছিল ৩ হাজার ১৭ জন, আর ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৬৩ জন। অর্থাৎ ২০২৪ সালের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে খুন বেড়েছে ৭ শতাংশ, আর দুই বছরের ব্যবধানে বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬ শতাংশ। পুলিশ সদর দপ্তরের সাম্প্রতিক অপরাধ তথ্যে এমন উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২০২৫ সালে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে জুলাই মাসে, ৩৬২টি। বিপরীতে সবচেয়ে কম খুন হয়েছে জানুয়ারিতে, ২৯৪টি। পুরো ১০ মাসে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১১ জন খুন হয়েছে।
বিভাগওয়ারি খুনের হিসাবে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি রাজধানীকেন্দ্রিক ঢাকা বিভাগে, ১ হাজার ১৮৬টি। এরপর চট্টগ্রাম বিভাগে ৬০৩টি, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে ৩২৫টি করে, রংপুরে ২২৩টি, ময়মনসিংহে ২০২টি, সিলেটে ১৯৩টি এবং বরিশালে ১৬২টি খুনের ঘটনা ঘটে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক উত্তেজনা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংঘর্ষ, আধিপত্য বিস্তার এবং পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ায় খুনের সংখ্যা হঠাৎ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা, চট্টগ্রাম, মুন্সিগঞ্জ, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক সমাবেশে সংঘর্ষ ও পাল্টা হামলা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে।
৫ নভেম্বর বিকেলে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও চালিতাতলী খন্দকারপাড়ায় নির্বাচনী জনসংযোগ করছিলেন চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ। জনসংযোগে অংশ নেওয়া সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা (৪৩) গুলিবিদ্ধ হন। পরে সন্ধ্যায় নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাঁকে গুলি করা হয় বলে জানায় পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক(এআইজি) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খুনের ঘটনা আগের মতোই রয়েছে। তবে সম্প্রতি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও ব্যক্তিগত আক্রোশ বা দ্বন্দ্বের কারণেই হত্যার ঘটনা ঘটছে। এ ছাড়া দেশে নির্বাচনী বছরে সহিংসতা স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে। এবারও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। তবে আমরা এরই মধ্যে নির্বাচনের আগে, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রস্তুতি নিয়েছি।’