জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মাধ্যমে জারি করা হয়েছে বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আদেশে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) সংলাপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ দলের দাবি পূরণের চেষ্টা দেখা গেছে। দলগুলোর দাবি পূরণে সরকারের ভারসাম্যমূলক নীতির প্রতিফলন আছে এই আদেশে।
জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট করার কথা বলা হয়েছে। এটি বিএনপির দাবি ছিল। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে (পিআর) উচ্চকক্ষ, তত্ত্বাবধায়কসহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) কার্যকর থাকবে না, যা জামায়াত ও এনসিপির দাবির পক্ষে গেছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই ধাপের সংলাপের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সনদে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেওয়া ৮৪টি বিষয় রাখা হয়। যেগুলোর মধ্যে সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাব রয়েছে। সনদের অঙ্গীকারনামায় গত ১৭ অক্টোবর সই করে বিএনপি, জামায়াতসহ সংলাপে অংশ নেওয়া ২৪টি দল। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রূপরেখা, গণভোটে সনদে আপত্তি থাকবে না এবং আদেশ প্রধান উপদেষ্টার মাধ্যমে জারির দাবি তুলে সেদিন স্বাক্ষর করেনি এনসিপি।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারির আলোচনার শুরুতেই বিরোধিতা করেছিল বিএনপি। দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের আদেশ জারির কোনো ক্ষমতা নেই। রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে প্রজ্ঞাপন দিয়ে গণভোট করার দাবি করেছিল বিএনপি। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপি আদেশ জারির দাবি করে আসছিল। তবে গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের নামে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ জারি করা হয়। আদেশে খুশি হলেও তা রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে হওয়ায় মনঃক্ষুণ্ন এনসিপি।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছে জামায়াতসহ সমমনা আটটি দল। অন্যদিকে বিএনপিসহ সংলাপে অংশ নেওয়া বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের দাবি জানিয়ে আসছিল। বৃহস্পতিবার জারি করা আদেশে বলা হয়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। ভোটের দিন গণভোটের সিদ্ধান্ত দেওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি করছে জামায়াত।
সংলাপে সংবিধানসংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবের সমাধান হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে ৩০টি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। বাকি ১৮টি প্রস্তাবে দলগুলোর আপত্তি ছিল। জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেয় কমিশন। সেখানে বলা হয়, গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হলে সনদে থাকা দলগুলোর আপত্তি কার্যকর হবে না। বিএনপি এই বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করে। দলটি সুপারিশকে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা বলে দাবি করে তখন। তবে কমিশনের সুপারিশে খুশি ছিল জামায়াত ও এনসিপি। পরে সরকার কমিশনের সুপারিশের কিছুটা সংশোধন করে সাতটি প্রস্তাবে আপত্তি রাখেনি। প্রস্তাবগুলো হলো—সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের (পিআর) ভিত্তিতে উচ্চকক্ষের গঠন; সংবিধান সংশোধন (সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ), তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা; ন্যায়পাল নিয়োগ; সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ; মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ; দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগ।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনে বাছাইয়ে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার (বিরোধী দল) এবং সংসদের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতার সমন্বয়ে বাছাই কমিটি গঠনে দলগুলো একমত হয়েছে। তবে বাছাই কমিটি একমত না হলে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট থেকে দুজন বিচারপতিকে কমিটিতে সমন্বয় করা হবে, যারা র্যাংকড চয়েজ (ক্রমভিত্তিক) ভোটিং পদ্ধতিতে প্রধান উপদেষ্টা বাছাই করবেন। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো র্যাংকড চয়েজের বিরোধিতা করে সংসদের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের পক্ষে অবস্থান নেয়। এখন গণভোটে হ্যাঁ জয়যুক্ত হলে এই প্রস্তাবে বিএনপির আপত্তি কার্যকর থাকবে না।
বাংলাদেশে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে অধিকাংশ দল একমত হলেও কমিশন প্রস্তাবিত পিআরে উচ্চকক্ষ গঠন এবং সংবিধান সংশোধনীর ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে দলগুলোর মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিম্নকক্ষের আসনের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা যেতে পারে এবং উচ্চকক্ষকে সংবিধান সংশোধনীর সুযোগ দেওয়া যাবে না। অন্যদিকে জামায়াত ও এনসিপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, পিআরের উচ্চকক্ষ এবং সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে নিম্নকক্ষের মতো উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে। আদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদনের কথা বলা আছে।
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সংবিধান ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ন্যায়পাল; সরকারি কর্ম কমিশনে নিয়োগ; মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ; দুর্নীতি দমন কমিশনে নিয়োগের বাছাই কমিটির বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হবে। যে কমিটিতে সরকারি দল, বিরোধী দল, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি থাকবে। জামায়াত, এনসিপি প্রস্তাবের পক্ষে ছিল। বিএনপি সংবিধান নয়, আইনের মাধ্যমে নিয়োগের পক্ষে ছিল। জারি করা আদেশ অনুযায়ী গণভোটে হ্যাঁ জয়ী হলে বিএনপির আপত্তি থাকবে না।
কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দলীয় প্রধান প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিষয়টি বিএনপির আপত্তি থাকলেও একমত ছিল জামায়াত ও এনসিপি। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থ বিল এবং আস্থা ভোট ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যরা দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার বিষয়ে সংলাপে অংশ নেওয়া জামায়াত, এনসিপিসহ অধিকাংশ দল একমত হয়েছিল। বিএনপিসহ তার সমমনা দলগুলো এই দুটি বিধানের সঙ্গে সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তায় (যুদ্ধ পরিস্থিতি) এমপিদের দলের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অধিকার দেওয়ার বিপক্ষে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী বিজয়ী দলগুলো সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে আদেশে বলা হয়েছে।
সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির অংশে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি উল্লেখ করার প্রস্তাব করে কমিশন। বিএনপি-জামায়াতসহ তাদের সমমনা দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন করার কথা জানিয়েছে। সিপিবি, বাংলাদেশ জাসদ, বাসদ, বাসদ-মার্ক্সবাদী বিদ্যমান সংবিধানে থাকা জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে বিষয়গুলো রাখার পক্ষে। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনী বিজয়ী দলগুলো সংলাপে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে পারবে বলে আদেশে বলা হয়েছে।
গণভোটের ফল ইতিবাচক হলে আগামী সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের কথা বলা আছে আদেশে। এ ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা একই সঙ্গে পরিষদের সদস্য হিসেবেও শপথ নেবেন। তাঁরা প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবেন। সংবিধান সংস্কার শেষ হওয়ার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদ নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের পিআরের ভিত্তিতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে। জামায়াত ও এনসিপি পরিষদ গঠনের পক্ষে থাকলেও বিএনপি এর বিপক্ষে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে এক সমাবেশে জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশের দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্ব যাতে খর্ব না হয়, সে জন্য আমরা কোনো আরোপিত আইন দিয়ে, আদেশ দিয়ে, কোনো রকমের জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব দিয়ে জাতীয় সংসদের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করতে দিতে চাই না।’
রাজধানীর মগবাজারে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক আট দলের এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘বিএনপি কখনোই আদেশ বা আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদকে সাংবিধানিক ভিত্তি দেওয়ার ব্যাপারে একমত ছিল না। তারা বিরোধিতা করেছিল; তারা একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে এই সংস্কারগুলো গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব করেছিল। এখানে সংস্কার কমিশন প্রস্তাবিত আদেশ দেওয়ার ওপর দৃঢ় ছিলেন ড. ইউনূস। এ জন্য তাঁকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।’
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘জুলাই সনদ আদেশ প্রধান উপদেষ্টার জারি করা, নোট অব ডিসেন্টের ব্যাপারে দলভেদে তারতম্য না করা এবং গণভোটের ফলাফলকে বাধ্যতামূলক করা—এই তিন বিষয়ের মীমাংসা না হওয়ায় আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকি। তবে জুলাই সনদ আদেশের যে গেজেট প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে আমাদের তোলা আপত্তির দুটি বিষয় একরকম সুরাহা করা হয়েছে। যদিও রাষ্ট্রপতিই আদেশ জারি করেছেন। এটা আদেশের নৈতিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের বিষয়টি এখনো বিবেচনাধীন।’