হোম > জীবনধারা > ভ্রমণ

টমাস কুক: যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল আধুনিক পর্যটনশিল্প

ফিচার ডেস্ক, ঢাকা 

এখন চাইলেই কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া যায়। ছবি: পেক্সেলস

এখন চাইলেই কোনো ট্রাভেল এজেন্সির সহায়তায় বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া যায়। সেটা আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায়। প্রশ্ন হলো, এই ট্রাভেল এজেন্সির ধারণা আর প্রতিষ্ঠাতা কে। ধারণাটা যে কারোরই হতে পারে। তবে প্রথম ট্রাভেল এজেন্সি তৈরি করেন এক ব্রিটিশ উদ্যোক্তা। নাম টমাস কুক। বিবিসি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস কিংবা গার্ডিয়ানের মতো সংবাদমাধ্যম যখন এ বিষয়ে একমত হয়েছে, তখন টমাস কুকের নাম আমরা নিতেই পারি।

ইতিহাস বলছে, ১৮৪১ সালে ব্রিটিশ উদ্যোক্তা টমাস কুক প্রথম বাণিজ্যিক ভ্রমণসেবা চালু করেন। এই উদ্যোগই পরবর্তীকালে ট্রাভেল এজেন্সির ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তাঁর এই যুগান্তকারী পদক্ষেপ পর্যটনশিল্পকে বদলে দিয়েছে অতিদ্রুত। সাধারণ মানুষকে সহজে ও সস্তায় ভ্রমণ করার সুযোগ এনে দিয়েছে। টমাস কুকের পরেই বিভিন্ন উদ্যোক্তা এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে থাকেন। কিন্তু এখনো প্যাকেজ ট্যুর ধারণার ৭৮ শতাংশ কুকের মডেল থেকে উদ্ভূত এবং বিশ্বব্যাপী ৬০ শতাংশ ট্রাভেল এজেন্সি তাঁর ব্যবসায়িক কাঠামো অনুসরণ করে থাকে।

১৮০৮ সালে ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারে জন্ম নেওয়া টমাস কুক যে একজন বিপ্লবী উদ্যোক্তা, সে কথা আমরা বলতেই পারি। দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া কুক শৈশবেই অর্থ উপার্জনসংক্রান্ত কাজ শুরু করেন। তাঁর অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও সাংগঠনিক দক্ষতা তাঁকে সে সময় অন্যদের থেকে পৃথক করে তোলে। প্রথমে তিনি একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মপ্রচারক হিসেবে কাজ করতেন। এ জন্য তাঁকে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে হতো। এসব ভ্রমণে তিনি আনন্দ পেতেন। ভ্রমণের প্রতি এই আগ্রহই তাঁকে নতুন পথে পরিচালিত করে।

ব্রিটিশ উদ্যোক্তা টমাস কুক। ছবি: উইকিপিডিয়া

মদ্যপানবিরোধী সমাবেশে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি প্রথম দলগত ভ্রমণ সংগঠিত করেন। সময়টা ১৮৪১ সালের ৫ জুলাই। টমাস কুক লিস্টার থেকে লাফবরো পর্যন্ত প্রথম সংগঠিত রেলভ্রমণের আয়োজন করেন। মাত্র ১১ মাইল দূরত্বের এ যাত্রায় টিকিটের মূল্য ছিল ১ শিলিং। সেযাত্রায় অংশ নিয়েছিল প্রায় ৫৭০ জন। এই সংগঠিত যাত্রার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভ্রমণের চাহিদা রয়েছে। সে বছরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন নিজের প্রতিষ্ঠান ‘টমাস কুক অ্যান্ড সন’। মাত্র দুজন কর্মচারী নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠান একটি পূর্ণাঙ্গ ট্রাভেল এজেন্সি হিসেবে রূপ নেয় ১৮৫১ সালে। টমাস কুক এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৮৪৫ সালে প্রথম বাণিজ্যিক ট্যুর আয়োজন করেন। সেটি ছিল লিভারপুল থেকে নিউক্যাসল পর্যন্ত। ১৮৫১ সালে লন্ডনে গ্রেট এক্সিবিশনের সময় কুক নিজের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার ভ্রমণকারী নিয়ে আসেন। এ ঘটনা তাঁকে পূর্ণকালীন ট্রাভেল এজেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করতে উদ্বুদ্ধ করে।

টমাস কুক শুধু ভ্রমণের টিকিট বিক্রি করতেন না; তিনি পুরো ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে সংগঠিত করতেন। টমাস কুক ভ্রমণের ক্ষেত্রে অনেক কিছু প্রথমবারের মতো চালু করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান কিছু যুগান্তকারী সেবা তৈরি করেছিল। যে সেবাগুলো এখনো বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি অনুসরণ করে। কুক তাঁর প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমবার যেসব সেবা দিতে শুরু করেন, সেগুলোর মধ্যে ছিল—

টমাস কুকের ভাস্কর্য। ছবি: উইকিপিডিয়া
  • প্যাকেজ ট্যুর, একই মূল্যে যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ও গাইডেড ট্যুরের ব্যবস্থা।
  • ট্রাভেলার্স চেক, আধুনিক ট্রাভেল কার্ডের পূর্বসূরি, যা ভ্রমণকারীদের নিরাপদে টাকা বহনে সাহায্য করত।
  • প্রথম আন্তর্জাতিক প্যাকেজ ট্যুর, ১৮৫৫ সালে প্যারিস এক্সপোজিশন ভ্রমণের জন্য তিনি প্রথম আন্তর্জাতিক প্যাকেজ ট্যুর চালু করেন। সেটি মহাদেশীয় ইউরোপে ব্রিটিশ পর্যটকদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
  • প্রথম সুইজারল্যান্ড ট্যুর, ১৮৬৩ সালে আয়োজিত এ ঘটনার মাধ্যমে আলপাইন পর্যটনের সূচনা হয়।
  • প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ট্যুর, ১৮৬৬ সালের এই আয়োজনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল ট্রান্স আটলান্টিক পর্যটন।
  • প্রথম মধ্যপ্রাচ্য ট্যুর, ১৮৬৯ সালে টমাস কুক নীল নদ ভ্রমণের আয়োজন করেন। সে আয়োজন ইউরোপীয়দের কাছে মিসর ভ্রমণ জনপ্রিয় করে তোলে।
  • বিশ্ব ভ্রমণ, ১৮৭২ সালে টমাস কুক দ্য গ্র্যান্ড ট্যুর চালু করেন, যা ছিল বিশ্বজুড়ে ২২২ দিনের একটি ট্যুর প্যাকেজ। এই ট্যুরে অংশগ্রহণকারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, চীন, সিঙ্গাপুর ও ভারত ভ্রমণের সুযোগ পেতেন।

ভিক্টোরিয়ান যুগে উচ্চবিত্তদের জন্য সীমিত ভ্রমণের সুযোগকে উনিশ শতকের ইউরোপে টমাস কুক মধ্যবিত্তদের জন্য উন্মুক্ত করেন। তিনি প্রথমবারের মতো নারী ও পরিবার নিয়ে নিরাপদ গ্রুপ ট্যুরের ব্যবস্থা করেন। তাঁর এসব আয়োজনে থাকত বিভিন্ন দেশের মধ্যে পর্যটন বৃদ্ধির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া তৈরির প্রচেষ্টা। এ ছাড়া টমাস কুক ভ্রমণ-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও প্রথম যত কিছু করেছিলেন, সেগুলো হলো—

  • ১৮৮০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠানটি বছরে ১০ লাখ টিকিট বিক্রি করত।
  • ১৯২৮ সালে নিজের প্রতিষ্ঠানকে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করা।
  • কুক তাঁর প্রথম ট্যুরে অংশগ্রহণকারীদের জন্য ব্র্যান্ডেড টিনের বাক্সে প্যাক করা লাঞ্চ সরবরাহ করতেন।
  • তিনি তাঁর ট্যুরে অংশ নেওয়া প্রত্যেক ভ্রমণকারীর নাম ও ঠিকানা রেকর্ড করে রাখতেন। এটি সম্ভবত প্রথম ট্রাভেল ডেটাবেইস।
  • টমাস কুক কিছু ট্যুরে চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করতেন। এটি আধুনিক ক্রুজ শিপের মেডিকেল সার্ভিসের পূর্বসূরি।

টমাস কুকের প্রতিষ্ঠানের দেওয়া প্যাকেজগুলোতে ভ্রমণ, থাকা-খাওয়া, গাইড সার্ভিস—সব একসঙ্গে পাওয়া যেত। তিনি এসব করতেন রেল কোম্পানিদের সঙ্গে চুক্তি করে সস্তায় গ্রুপ টিকিট কেনার মধ্যেমে। তিনি যে শুধু প্যাকেজ ট্যুর পরিচালনা করতেন, তা-ই নয়। প্রকাশ করতেন ‘দ্য এক্সক্রুশনিস্ট’ নামের একটি ভ্রমণবিষয়ক ম্যাগাজিন। তাতে টমাস কুকের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ভ্রমণের বিবরণ থাকত।

কুক অ্যান্ড সন্স এর সাবেক অফিস। ছবি: নিউজ ডট স্কাই ডট কম

টমাস কুক শুধু একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেননি। তিনি একটি শিল্পের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর মডেল অনুসরণ করে পুরো বিশ্বে ট্রাভেল এজেন্সি ব্যবসা বিস্তার লাভ করে। আজ টমাস কুক গ্রুপ নামে পরিচিত প্রতিষ্ঠানটি একসময় বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাভেল কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল।

টমাস কুকের দূরদর্শিতা ও সৃজনশীলতা ভ্রমণশিল্পকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। তিনি শুধু একটি ব্যবসা গড়ে তোলেননি, বরং মানুষের ভ্রমণ করার ধারণাকেই বদলে দিয়েছিলেন। আজ আমরা যেভাবে সহজে পর্যটন স্পটগুলো ভ্রমণ করি, তার পেছনে রয়েছে প্রথম জীবনে ধর্মপ্রচারক টমাস কুকের ভূমিকা। তাঁর গল্প শুধু ব্যবসায়িক সাফল্যের নয়; বরং কীভাবে একটি ধারণা বিশ্বকে বদলে দিতে পারে, তার অনন্য উদাহরণ।

সূত্র: বিবিসি (২০১৯), দ্য গার্ডিয়ান (২০১১), হিস্টরিক-ইউকে ডট কম, লোনলিপ্ল্যানেট ডট কম, টেলিগ্রাফ ডট কম ডট ইউকে, এফটি ডট কম।

গ্রামের নাম মহিষখোলা

মাধবকুণ্ড ঝরনার পানিতে বিরল ঝরনাপাখি

বাংলাদেশের পর্যটক কমায় ভারতে নিম্নমুখী আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীর সংখ্যা

আকাশে ঘুরে বেড়ানো এক নিঃসঙ্গ বাবার গল্প

হোটেল রুমের পরিচ্ছন্নতা ও শিষ্টাচার

ভ্রমণে এক ব্যাগে সবকিছু রাখলে বিপদ হতে পারে, দেখে নিন কী করবেন

আবুধাবি ভ্রমণের আগে যা জানা জরুরি

২০২৬ সালের জন্য এয়ারবিএনবি-এর পূর্বাভাস

পর্যটকের স্রোতে বিপর্যস্ত শহর

বিমানযাত্রার অলিখিত নিয়মগুলো জেনে নিন