১৭ জুন ২০১৮। আকাশে ঈদের চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। এভারেস্টকে পেছনে রেখে সেই চাঁদের সঙ্গেই শ্বেতশুভ্র পথ দিয়ে হেঁটে চলছি আমরা ছয়জন। আইসবুটে লাগানো ক্রাম্পনের কাঁটায় বরফ কচকচ করে কাটছে।
পাঠকের মনে এতক্ষণে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, কোন পর্বত অভিযানে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। ঘটনাবহুল এই অভিযানে গিয়েছিলাম ২০১৮ সালের মে মাসে। বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের সদস্য হিসেবে এই অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। দলে আরও ছিলেন এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত ও অভিজ্ঞ পর্বতারোহী কাজী বাহালুল মজনু। এ ছাড়া আমাদের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসেবে ছিলেন নেপালের তিনজন গাইড শেরপা।
আক্ষরিক অর্থে অর্ধেক এভারেস্ট অভিযানের রোমাঞ্চ পেয়েছি লাকপারি অভিযানে। তিব্বতের দিক দিয়ে এভারেস্ট বেসক্যাম্প গাড়িতে করেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আমরা নেপালের থামেল থেকে গাড়িতে করে নেপাল-চায়না বর্ডারের রসুয়াগাডি নামের একটি জায়গায় উপস্থিত হই। সেখান থেকে পরদিন সীমান্তের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে তিব্বতের কেরুং নামের একটি শহরে আসি। পরদিন সেই শহরে থাকি আমরা।
আমরা ৮ মে দুপুর ১২টা নাগাদ বেসক্যাম্প পৌঁছে যাই। কী চমৎকার আবহাওয়া যে ছিল সেদিন! তবে প্রচণ্ড বাতাস। আশপাশে শত শত তাঁবু। বিশাল ময়দানের মতো একটা জায়গায় যেন মেলা বসেছে। সবাই এভারেস্ট অভিযানে এসেছে। আমরাই শুধু লাকপারি পাহাড়ের অভিযাত্রী!
পরবর্তী তিন দিন চলল আমাদের অ্যাক্লাটামাইজেশন; অর্থাৎ উচ্চতার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে বেসক্যাম্পের পাশে উঁচু পাহাড়ে ট্রেকিং। চতুর্থ দিন আমরা এভারেস্ট মিডলক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে রাত কাটিয়ে পরদিন এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে পৌঁছে যাই। এর উচ্চতা ৬ হাজার ৩০০ মিটার। এভারেস্ট অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে আমরা আরও তিন দিন কাটাই। এর মধ্যে এভারেস্ট ক্রাম্পন পয়েন্ট ঘুরে আসি।
দলের সবাই সুস্থ। ১৭ মে রাত আড়াইটায় আমরা লাকপারি পর্বতের চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। দলে আমরা মোট ছয়জন। তিন অভিযাত্রী ও আমাদের তিনজন দক্ষ গাইড। রাতের অন্ধকারে হেডলাইটের আলোতে এগিয়ে যাচ্ছি ধীরে ধীরে। আর ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষা করছি। রোদ উঠলে ঠান্ডা কিছুটা কমে আসবে, সেই আশায়।
আলো ফুটলেই চোখের সামনে লাকপারির দেখা পাই। মনে হচ্ছে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। খুব সহজে পৌঁছে যাব আমরা। এসব ভাবতে ভাবতে সামনে হাঁটছি। সুয্যি মামা উঠি উঠি করছে। আমরা শীতে জমে যাচ্ছিলাম প্রায়। সবার সামনে আমাদের প্রধান গাইড দাওয়া শেরপা। তাঁর পেছনে এম এ মুহিত এবং তাঁর পেছনেই আমি হাঁটছি। আমার পেছনে আরও তিনজন। আমরা সবাই মেইন রোপে বাঁধা অবস্থায় হাঁটছি।
ঘড়িতে তখন বেলা প্রায় ৩টা। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা একটানা হেঁটে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৩ হাজার ১১৩ ফুট উঁচু থেকে নিচের দিকে তাকিয়েছিলাম, তখন ঠিক কী অনুভূতি হয়েছিল, তা আজ আর মনে করতে পারছি না। বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি লাকপারির চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি। তবে সত্যি বলতে এতটাই ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ছিলাম যে তখন বারবার মনে হচ্ছিল, কখন আমি তাঁবুতে ফিরে গিয়ে পা দুটোকে একটু বিশ্রাম দেব আর পেট ভরে খেতে পারব। মনের মধ্যে যখন এসব এলোমেলো ভাবনা খেলা করছিল, তখনই ভ্রম ভাঙালেন দাওয়া শেরপা। বললেন, দ্রুত ছবি তোলো, ফিরতে হবে। এই দীর্ঘ পথ ফিরতে হবে ভেবে আমার আবার চিন্তা বেড়ে গেল।
লাকপারির চূড়ায় আধা ঘণ্টার মতো থেকে আমরা ফিরতি পথ ধরি। রাত সাড়ে ৯টার আশপাশে অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পে পৌঁছাই। এই ফেরার পথটুকু আমি কীভাবে হেঁটেছি মনে নেই। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি স্বপ্ন দেখছি। তাঁবুতে পা রেখে অবচেতন হয়ে পড়লাম। আমার আবছা মনে পড়ছে, কোনো এক শেরপা দ্রুত আমার শরীর থেকে হার্নেস সেট, আইসবুট আর উইন্ডপ্রুফ জ্যাকেট খুলে দিচ্ছেন। কেউ একজন গরম পানি হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন পানের জন্য। স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লেগেছিল আমার। এখনো সে ঘোর চোখেমুখে লেগে আছে। সেই রাতের কথা মনে পড়লে এখনো আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।