শীত এসেছে। সেই সঙ্গে খাবারদাবারের জগতেও পাওয়া যাচ্ছে আলাদা আমেজ। সেই আমেজে রাজধানী ঢাকার রেস্তোরাঁগুলোও হয়ে উঠেছে উৎসবমুখর। শহরে শীতের সন্ধ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুরু হয়েছে বুফে ডিনারের দারুণ সব আয়োজন। হোটেল থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ, প্রায় সবখানেই চোখে পড়ছে উইন্টার বুফে বা শীতের বিশেষ বুফের নান্দনিক বিজ্ঞাপন।
বুফে: ইতিহাস ও বিবর্তন
‘বুফে’ শব্দটি ফরাসি। এর অর্থ হলো যে সুসজ্জিত টেবিলে বিভিন্ন খাবার সাজানো থাকে এবং অতিথিরা পছন্দমতো নিজেরাই খাবার তুলে নেয়। আঠারো শতকের ইউরোপে এই ধারণার শুরু হলেও বাংলাদেশে এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সম্প্রতি। শীতকালে এর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়। এ সময় তাজা শাকসবজি, মৌসুমি ফলের প্রাচুর্য এবং মন ভালো করা আবহাওয়া মানুষের বৈচিত্র্যময় খাবারের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
ঢাকার বুফে সংস্কৃতি
ঢাকার বুফে আসলে শুধু খাবারের আয়োজন নয়, এটি এ শহরের নাগরিক সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে ক্রমশ। দিন দিন এ শহরের অধিবাসীদের বুফে খাবারের প্রবণতা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বুফে রেস্তোরাঁ। পুরান ঢাকা থেকে শুরু করে গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে বুফে খাবারের অসংখ্য রেস্তোরাঁ। সপ্তাহের শেষে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান বা অফিসের অনানুষ্ঠানিক মিটিং; সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় বুফে টেবিল।
বুফের আইটেমগুলোও হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। একদিকে রয়েছে দেশীয় স্বাদের সমাহার। তাতে পাওয়া যায় কাচ্চি বিরিয়ানি, মুরগি, খাসি ও গরুর মাংসে রান্না নানান পদের খাবার, বিভিন্ন ধরনের কাবাব ইত্যাদি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক খাবারের মধ্যে পাওয়া যায় চায়নিজ, ইতালিয়ান পাস্তা, জাপানিজ সুশি, ম্যাক্সিকান ট্যাকোস ইত্যাদি। ডেজার্টের টেবিলও কম আকর্ষণীয় নয়; পায়েস, ফিরনি, কাস্টার্ড থেকে আধুনিক চিজ কেক, আইসক্রিম, ফ্রুট সালাদসহ প্রায় সব ধরনের ডেজার্টই পাওয়া যায় বুফে টেবিলে।
আর বিশেষভাবে পাওয়া যায় ভারতীয় বিভিন্ন খাবার।
বুফে উপভোগের কৌশল: কীভাবে বেশি ও ভালোভাবে খাবেন
বুফে মানেই খাওয়ার স্বাধীনতা। কিন্তু এই স্বাধীনতা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে কিছু কৌশল জানা জরুরি।
১. স্কাউটিং বা আগে ঘুরে দেখা
খাবার প্লেটে নেওয়ার আগে পুরো বুফে টেবিল একবার ঘুরে দেখুন। তাতে কী কী আইটেম আছে, কোনটা কোথায় সাজানো, কোন কোন খাবার আপনি খেতে চান; এগুলো জেনে নিলে খাওয়ার পরিকল্পনা করা সহজ হয়। এতে অনেক কিছু না খেয়ে আপনি পছন্দের খাবারগুলো আরামে খেতে পারবেন।
২. ছোট প্লেট, বেশি রাউন্ড
বড় একটি প্লেট ভরে ফেললে প্রথম দিকে বেশি খাবার তুলে নিলেও পরে আর খেতে ইচ্ছে নাও করতে পারে। বরং ছোট প্লেটে অল্প করে কয়েক বারে খাবার নিন। এতে প্রতিবারই তাজা ও গরম খাবার পাওয়া যায় এবং খেতে ক্লান্তি কম লাগে।
৩. হালকা শুরু, ভারী শেষ
হালকা খাবার দিয়ে বুফে শুরু করুন। সালাদ বা স্যুপের মতো হালকা কোনো আইটেম দিয়ে খাওয়া শুরু করুন। তারপর মূল খাবার এবং শেষে ডেজার্ট উপভোগ করুন। ভারী বা তৈলাক্ত খাবার দিয়ে শুরু করলে অল্পেই পেট ভরে যেতে পারে। তাতে বুফে খাবারের আনন্দ উপভোগ অধরা থেকে যাবে।
৪. পানি পান, কিন্তু সঠিক সময়ে
বুফে খাওয়া শুরুর আগে বা মাঝখানে অতিরিক্ত পানি পান করলে পেট ভরা ভরা লাগতে পারে। তাই অল্প অল্প পানি পান করুন। পানি পানের ক্ষেত্রে কোমল পানীয় এড়িয়ে গিয়ে সাধারণ পানি পান করুন। মিষ্টি পানীয় দ্রুত পেট ভরিয়ে দিতে পারে।
৫. ধীরে ও ভালোভাবে চিবিয়ে খান
বুফে দেখে উত্তেজিত হয়ে দ্রুত খাওয়ার প্রবণতা থাকে। কিন্তু দ্রুত খেলে বেশি খাওয়া যায় না, উল্টো হজমের সমস্যা হতে পারে। তাই প্রতিটি খাবার ভালো করে চিবিয়ে, সময় নিয়ে খান। এতে স্বাদও বেশি উপভোগ করবেন, আবার পরিমাণেও বেশি খেতে পারবেন।
৬. নেগেটিভ স্পেসের ব্যবহার
প্লেটে খাবার সাজানোর সময় কিছু ফাঁকা জায়গা রাখুন। এতে খাবারগুলো আলাদা স্বাদ বজায় রাখে এবং দেখতেও সুন্দর লাগে। সবকিছু গাদাগাদি করে দিলে স্বাদ মিশে যেতে পারে।
৭. প্রোটিন ও শাকসবজির সমন্বয় করুন
মাছ, মাংস বা ডালের মতো প্রোটিন এবং শাকসবজির সমন্বয় করে খাবার নিন। এতে খাবার উপভোগ্য হয় এবং পুষ্টিগুণও বজায় থাকে।
শিষ্টাচার ও সতর্কতা
রেস্তোরাঁয় বুফে খেতে গেলেও মনে রাখবেন, এটি একটি সামাজিক আয়োজন। আপনিই শুধু নন, অনেকে আসবে বুফে উপভোগ করতে। তাই কিছু শিষ্টাচার মেনে চলুন।
শীতের বুফে আসলে খাদ্যের উৎসব। এটি আমাদের খাদ্য সংস্কৃতির একটি আধুনিক প্রকাশ। সঠিক পদ্ধতি ও শিষ্টাচার মেনে এই আয়োজন উপভোগ করলে এটি হয়ে উঠতে পারে সপ্তাহ বা মাসের সেরা গেট টুগেদার। তাই এই শীতে প্রিয়জনদের সঙ্গে সময় কাটানোর পাশাপাশি স্বাদের এক নিখুঁত যাত্রা করতে বসে যেতে পারেন কোনো সুপরিচিত রেস্তোরাঁর বুফে টেবিলে। মনে রাখবেন, বুফে মানেই ভালো থাকার খোরাক। তবে অতিরিক্ত নয়, পরিমিতিবোধের মধ্যেই এর আসল স্বাদ নিহিত।