আপনি নির্ভয়ে আলু ভাজা খাচ্ছেন। সকালের নাশতায় ডিম কিংবা ওটমিল খাচ্ছেন। কিন্তু জানেন কি, একসময় এই খাবারগুলো ছিল সমাজের চোখে ঘৃণিত, নিন্দিত, এমনকি নিষিদ্ধ? মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস আসলে সাংস্কৃতিক ভুল ধারণা, সামাজিক বৈষম্য আর বিজ্ঞানের হাত ধরে এক দীর্ঘ বিবর্তনের গল্প। কিছু জনপ্রিয় খাবারের এমন বিস্ময়কর ইতিহাস রয়েছে, যা এখন আপনার বিশ্বাস করাই কঠিন হতে পারে। একটা সময় আলু ও বেগুনের মতো সবজিগুলো রোগ, কুসংস্কার ও জাদুবিদ্যা বা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে মনে করা হতো। খাদ্যের গ্রহণযোগ্যতা শুধু তার পুষ্টি ও স্বাদের ওপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সংস্কৃতি, সামাজিক ইতিহাস, অর্থনীতি, এমনকি বিপণনের কৌশল।
আলু, টমেটো ও বেগুন
বাঙালি তরকারি কিংবা বিরিয়ানি আলু ছাড়া কল্পনা করতে পারে না। ভাবনাতেও কখনো আসবে না আলুর মতো সাধারণ একটি সবজি বিপজ্জনক হতে পারে। কিন্তু আলুতে সোলানিন নামক বিষাক্ত পদার্থ তৈরি হতে পারে। এটি শরীরের পক্ষে বিপজ্জনক হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে ১৮ শতকের ফ্রান্সে মানুষ আলু এড়িয়ে চলত একেবারে ভিন্ন কারণে। তখন বিশ্বাস করা হতো, আলু খেলে কুষ্ঠরোগ ও ‘অশুদ্ধ কামনা’ জন্মায়। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে একসময় আলু চাষ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
টমেটো একসময় আক্ষরিক অর্থে ‘ঘাতক’ হিসেবে কুখ্যাত ছিল। বেশ কিছু মানুষ এটি খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া বা মারা যাওয়ার পর টমেটো কুখ্যাত হয়ে ওঠে। কিন্তু টমেটোতে নয়, তারা যে পিউটার প্লেটে টমেটো খাচ্ছিল, সমস্যা ছিল তাতে। এই প্লেটগুলোতে প্রচুর পরিমাণে সিসা থাকত, যা টমেটোর অ্যাসিডিক রসের সংস্পর্শে এসে আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে উঠত।
মধ্যযুগে বেগুন ছিল এক ভীতিকর সবজির নাম। এই ধারণা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ইতালিতে এটিকে মালা ইসানা বা পাগল আপেল এবং ফ্রান্সে পোম্মে দেশ ফোস বা পাগলদের আপেল নাম দেওয়া হয়েছিল। তিতা স্বাদ আর নাইট শেড পরিবারের অংশ হওয়ার কারণে বেগুনকে বিষাক্ত ও মন-পরিবর্তনকারী প্রভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত সবজি বলে মনে করা হতো।
গলদা চিংড়ি, শেলফিশ, টুনা
গলদা চিংড়িকে এখন যতই দামি ও সুস্বাদু খাবার মনে করুন না কেন, একসময় নিউ ইংল্যান্ডের উপকূলে এটি পরিচিত ছিল ‘সমুদ্রের আরশোলা’ নামে। এটি ছিল টেবিলের অযোগ্য খাবারগুলোর অন্যতম। শুধু বন্দী ও দরিদ্র মানুষ এবং পশুকে খাওয়ানো হতো গলদা চিংড়ি। অথবা সার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মূলত সহজলভ্য ছিল বলে গলদা চিংড়ির ঘাড়ে জুটেছিল এই দুর্নাম। ক্যানজাত হয়ে রেলপথে পরিবহনের কারণে এটি একসময় আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছাতে শুরু করলে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি ‘স্বল্প বরাদ্দকৃত’ খাবারের তালিকায় ছিল না বলে এটি অনেক পরিবারের প্রধান খাবার হয়ে ওঠে।
এদিকে ক্ল্যাম, ঝিনুক, চিংড়িজাতীয় শেলফিশ ঐতিহাসিকভাবে ইহুদি ও ইসলামের কিছু শাখা এবং খ্রিষ্টধর্মের কিছু অংশে নিষিদ্ধ খাবারের তালিকায় ছিল। প্রাচীন মিসর ও মধ্যযুগীয় ইউরোপে এগুলোকে অপরিষ্কার বলে মনে করা হতো। এসব খাবারকে দারিদ্র্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হতো। যদিও খাদ্যনিরাপত্তা এখন অনেক উন্নত। কিন্তু এসব খাবারে এখনো খানিক বিষক্রিয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইয়েলোফিন ও স্কিপজ্যাক টুনা আমেরিকায় নিম্নমানের খাবার বলে বিবেচিত হতো একসময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরে ঘটে যাওয়া মহামন্দার পর এই ধারণা পাল্টায়। সে সময় থেকে আমেরিকানরা সব ধরনের টুনাকে তাদের খাদ্যতালিকায় জায়গা দিতে শুরু করে এবং এটিকে মূল্যবান প্রোটিন উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বর্তমানে ব্লুফিন টুনা বিশ্বের অন্যতম মূল্যবান মাছের প্রজাতি।
মাশরুম
বিষাক্ত মাশরুম খেলে অবশ্যই বিপদ হতে পারে। তবে বহু বছর ধরে মাশরুমের যোগ ছিল জাদুবিদ্যা ও মৃত্যুর সঙ্গে! বর্তমানে ভোজ্য জাতের মাশরুম চিহ্নিত হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে তা নিরাপদে খাওয়া হয়। তবে সাম্প্রতিক ইতিহাসেও কিছু মাশরুমকে খাওয়ার অযোগ্য হিসেবে দেখা হয়। ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত, পরিপক্ব ক্রিমিনি বা বেবি বেলা ও পোর্টোবেলো মাশরুম আমেরিকায় খাওয়ার উপযোগী বলে বিবেচিত হতো না। তবে আকর্ষণীয় ইতালীয় নাম এবং অসংখ্য রেসিপি দিয়ে বিপণন শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
কফি
কফির উদ্দীপক বৈশিষ্ট্যের জন্য এটি ষোলো ও সতেরো শতকে তার জনপ্রিয়তা হারায়। মানুষ একে সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করে। ফলে এটি বিশ্বের কিছু অংশে নিষিদ্ধ হয়। ক্যাথলিকরা এটিকে ‘শয়তানের পানীয়’ নামে ডাকত। আবার ১৬৭৪ সালে লন্ডনে নারীরা এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তারা দাবি করে, কফি পুরুষদের বন্ধ্যা করে দিচ্ছে। এমন দীর্ঘ সংগ্রাম করে কফি আজ আমাদের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে।
চকলেট
চকলেট যখন ইউরোপে আসে, তখন কিছুটা দুর্নাম কুড়িয়েছিল। চকলেটজাতীয় পানীয়কে যৌন উদ্দীপক এবং অতি ভোজন সৃষ্টিকারী বলে মনে করা হতো। এ দুটি কারণে চকলেট মানুষের কাছে ‘পাপপূর্ণ’ খাবার হিসেবে বিবেচিত হতো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চকলেট সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তিত হয়। আর এখন এর জনপ্রিয়তা আপনি নিজেই ভালো করে জানেন।
রসুন
রসুন একটি দুর্দান্ত খাবার হলেও এর তীব্র গন্ধ ইংল্যান্ডে ও আমেরিকার মানুষদের অনেক অপছন্দের ছিল। তবে ইতালীয় ও অন্যান্য অভিবাসীরা তাদের রন্ধনশৈলীতে রসুনের ব্যবহার করলে আমেরিকায় রসুনবিরোধী মনোভাব কমে যায় এবং এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশেও আপনি কি রসুন ছাড়া অনেক খাবার কল্পনা করতে পারবেন?
সূত্র: বেটার ম্যাগাজিন, হিস্ট্রি কালেকশন, মেন্টাল ফ্লস, ইয়াম ফিলি