হোম > বিশ্ব > মধ্যপ্রাচ্য

নতুন বাস্তবতায় গাজায় অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মরিয়া হামাস

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

২০০৭ সাল থেকে গাজা উপত্যকার একমাত্র শাসক ছিল হামাস। ছবি: এএফপি

ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের মুখে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে হামাস। শীর্ষ কমান্ডারদের হারানো, সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ধ্বংস ও ইরান থেকে ভবিষ্যৎ সহায়তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় গাজায় অস্তিত্ব রক্ষা করাই এখন সংগঠনটির প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হামাসের ঘনিষ্ঠ তিনটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানায়, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় সংগঠনের যোদ্ধারা স্বতন্ত্রভাবে কাজ করছেন। তবে ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পাওয়া স্থানীয় কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও এখন তাদের লড়তে হচ্ছে।

রয়টার্সকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এক বিদ্রোহী নেতা ইয়াসির আবু শাবাবকে হত্যা করতে হামাস তাদের শীর্ষ যোদ্ধাদের পাঠালেও তিনি এখনো গাজার রাফা এলাকায় ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলে নিরাপদে রয়েছেন। ওই অঞ্চলেই তিনি একটি স্বতন্ত্র প্রশাসন গঠনের চেষ্টা করছেন। তবে আবু শাবাবের দল দাবি করছে, তারা কোনো ইসরায়েলি সহায়তা পায় না এবং কেবল মানবিক সহায়তা বণ্টনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তারা স্থানীয় লোকদের ফেরার আহ্বান জানিয়ে খাদ্য ও আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে হামাস তাঁকে ‘সহযোগী’ হিসেবে অভিযুক্ত করে ‘লোহা মুষ্টিতে’ দমন করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

হামাসের কিছু ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, গাজায় দখল ধরে রাখতে তারা যুদ্ধবিরতির পক্ষপাতী—এমনকি সাময়িক যুদ্ধবিরতিও তাদের জন্য জরুরি। কারণ, এতে ক্লান্ত জনগণ কিছুটা স্বস্তি পাবে। পাশাপাশি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও ত্রাণ লুটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে হামাস।

ইসরায়েলি এক সামরিক কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, তারা ২০ হাজার বা তার বেশি হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে এবং শত শত মাইল সুড়ঙ্গ ধ্বংস করে ফেলেছে। যদিও হামাস তাদের নিহত সদস্যদের সংখ্যা প্রকাশ করেনি। রয়টার্স হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্র, ইসরায়েলি নিরাপত্তা সূত্র, কূটনীতিকসহ ১৬ জনের সঙ্গে কথা বলেছে, যারা হামাসের একটি গুরুতর দুর্বল চিত্র তুলে ধরেছে। তবে তা সত্ত্বেও গাজায় তাদের কিছু প্রভাব এবং অপারেশনাল সক্ষমতা রয়েছে।

গাজা নগরীর বাসিন্দা ৫৭ বছর বয়সী ইসসাম বলেন, ‘তারা (হামাস) আগের মতো নেই, তবে এখনো বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়—তারা লোকজনকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে, ত্রাণের ট্রাক পাহারা দিচ্ছে কিংবা অপরাধীদের শাস্তি দেয়।’

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হামাস বর্তমানে সীমিত হামলা চালাতে সক্ষম। সংগঠনের সদস্যদের ‘গড় বয়স’ দিন দিন কমে আসছে। কারণ, তাঁরা দারিদ্র্যপীড়িত, বাস্তুচ্যুত তরুণদের থেকে যোদ্ধা সংগ্রহ করছে। তবে এখনো তারা পাল্টা আঘাত হানতে সক্ষম। যেমন—গত মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজায় হামাসের হামলায় সাতজন ইসরায়েলি সেনা নিহত হয়েছে।

গাজায় মানবিক সংকট চরমে পৌঁছানোয় আন্তর্জাতিক মহল যুদ্ধবিরতির জন্য জোরালো চাপ দিচ্ছে। হামাসের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সামি আবু জুহরি রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ শেষ করতে একটি সমঝোতার জন্য প্রস্তুত। তবে আত্মসমর্পণ কোনো বিকল্প নয়।’ তিনি বলেন, হামাস সব বন্দীকে একসঙ্গে মুক্তি দিতে প্রস্তুত, তবে যুদ্ধ থামাতে হবে এবং ইসরায়েলকে গাজা থেকে সরে যেতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, গাজা সংকট সমাধানে ‘গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি’ হয়েছে এবং ইরানে হামলা বন্দীদের মুক্তিতে সহায়ক হবে।

এদিকে হামাসের সামরিক সক্ষমতা গড়ে তুলতে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তবে ইসরায়েলি বোমা হামলায় ইরানে ইসলামি বিপ্লবী গার্ডের কর্মকর্তা সাঈদ ইজাদি নিহত হওয়ার পর তেহরানের সমর্থনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। তিনি ছিলেন হামাসের সঙ্গে সমন্বয়ের দায়িত্বে। ফিলিস্তিনি এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইরানের সহায়তা কমে আসতে পারে, বিশেষ করে অর্থায়ন ও সামরিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে। এর প্রভাব হামাসের প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর পড়তে পারে।

হামাস ইজাদির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে জানিয়েছে, তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু। হামাস ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র রয়টার্সকে বলে, ‘আমরা বিশ্বাস হারাইনি, তবে বাস্তবতা বলছে—পরিস্থিতি ভালো নয়।’

বৈরুতের কার্নেগি মিডল ইস্ট সেন্টারের সিনিয়র ফেলো ইয়াজিদ সাইঘ রয়টার্সকে বলেন, ‘হামাস এখন শুধু অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে—শুধু সামরিকভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবেও। যদি যুদ্ধ বন্ধ না হয়, তারা গাজা থেকে চিরকালের জন্য মুছে যেতে পারে। আবার কোনো রাজনৈতিকভাবেও তারা জায়গা হারাতে পারে।’

হামাস এখন সেই গোষ্ঠীর একটি ছায়ামাত্র, যারা ২০২৩ সালে ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছিল। ইসরায়েলি হিসাব অনুযায়ী, সেই হামলায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয় এবং ২৫৩ জনকে জিম্মি করা হয়। এই হামলার ঘটনার পরে থেকে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন চলছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ইসরায়েলের আক্রমণে এখন পর্যন্ত ৫৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল হামাসের যে ক্ষতি করেছে, তা তাদের প্রতিষ্ঠার পর থেকে এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড়। গাজায় তাদের বেশির ভাগ শীর্ষ সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন।

১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হামাস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফাতাহ গোষ্ঠীর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। এরপর ২০০৭ সালে পুরো গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। কিন্তু এই হামাস এখন এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি। ইসরায়েলি দমন-পীড়নের মুখে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্ব হারিয়ে তারা ছায়া-সংগঠন হিসেবে টিকে থাকার চেষ্টা করছে। অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, আন্তর্জাতিক চাপ ও ইরানের বর্তমান পরিস্থিতি এই সংকটকে আরও গভীর করে তুলেছে। যদিও তারা আত্মসমর্পণ না করার ঘোষণা দিয়েছে, কিন্তু সময় যত গড়াচ্ছে, ততই প্রতিরোধের ক্ষমতা ও রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা হারানোর শঙ্কা বাড়ছে।

গাজায় হামাসবিরোধী ইসরায়েলি প্রক্সি গোষ্ঠীর নেতা ইয়াসির আবু শাবাব নিহত, কে তিনি

গাজায় যুদ্ধবিরতি খুব ভালোভাবে চলছে, দ্বিতীয় ধাপ শুরু শিগগির: ট্রাম্প

মার্কিন মধ্যস্থতায় ৪০ বছরের মধ্যে প্রথমবার সরাসরি আলোচনায় লেবানন-ইসরায়েল

ফিলিস্তিনের নেলসন ম্যান্ডেলা: বারঘৌতির মুক্তির দাবিতে সোচ্চার দুই শতাধিক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব

‘সর্বত্র ভূত দেখে’ যত্রতত্র ‘বোমা ফেলছেন বিবি’, লাগাম টানতে ব্যর্থ যুক্তরাষ্ট্র

ফিলিস্তিন রাষ্ট্রই একমাত্র সমাধান—পোপ

দুর্নীতির মামলায় প্রেসিডেন্টের কাছে নেতানিয়াহুর ক্ষমা প্রার্থনা

গাজার পুলিশ বাহিনী গঠনে হাজারো ফিলিস্তিনিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে মিসর

যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজায় ইসরায়েলি হামলা চলছে, নিহত ৭০ হাজার ছাড়াল

সংঘবদ্ধ নির্যাতন ‘কার্যত’ ইসরায়েলের রাষ্ট্রনীতি, কুকুর হামলা, যৌন নির্যাতনের চিত্র জাতিসংঘের প্রতিবেদনে