কয়েক দিন আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের স্কুলশিক্ষক সর্বেশ কুমারকে তাঁর বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে তিনি নাকি একটি ভিডিও বানিয়েছিলেন, যেখানে তাঁকে কাঁদতে দেখা যায়। সেখানে তিনি নির্বাচনী কাজের চাপের কথা বলেছিলেন এবং সময়মতো কাজটি শেষ করতে না পারায় খুবই হতাশ ছিলেন।
ভিডিওতে তিনি বলেছিলেন, ‘বিশ দিন ধরে আমি এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। হাতে যদি একটু সময় থাকত, তা হলে এই কাজটা শেষ করে দিতে পারতাম।’ সর্বেশ ছিলেন সেই সব হাজার হাজার সরকারি কর্মীর একজন, যাদের গত ৪ নভেম্বর থেকে ১২টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৫০ কোটিরও বেশি ভোটারের তালিকা তৈরির কাজে নামানো হয়েছিল।
ভারত সরকার পরিচালিত স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা বিশেষ নিবিড় সংশোধনী—এসআইআর নামে পরিচিত এই কর্মসূচির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন (ইসি) চাইছে, প্রত্যেক যোগ্য ভোটারের নাম তালিকায় তোলা হোক এবং অযোগ্য নামগুলো বাতিল করা হোক।
সাধারণত সরকারি স্কুলশিক্ষক, কর্মচারী ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা বুথ লেভেল অফিসার বা বিএলও হিসেবে ইসির তৃণমূল পর্যায়ের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফরম বিতরণ করেন, কাগজপত্র যাচাই করেন, নানা প্রশ্নের জবাব দেন ও নির্ভুল তথ্য আপলোড করেন। এই পুরো কাজের সময়সীমা মাত্র এক মাস।
তবে শুধু এটুকুই নয়। অনেক নির্বাচনী কর্মী—যাদের অনেকেই আবার প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বা অঙ্গনওয়াড়ি (সরকার পরিচালিত শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র) কর্মী—বলেন, অনেক সময় তাঁদের নিজের নিয়মিত কাজের পাশাপাশি নির্বাচনী দায়িত্বও সামলাতে হয়।
বিবিসি রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য উত্তর প্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে দশ জন বিএলও’র সঙ্গে কথা বলেছে। তাঁরা জানিয়েছেন, সামান্য বিশ্রাম, কম ঘুম ও নগণ্য পারিশ্রমিক নিয়ে তাঁদের দিনে ১৪-১৫ ঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে। এই দুই রাজ্যেই এসআইআর কাজ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।
এই শ্রমসাধ্য সময়সূচির কারণে বিএলওদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। বিশেষত কুমারসহ এক ডজনেরও বেশি কর্মীর মৃত্যুর পর এই ক্ষোভ আরও বেশি বেড়েছে। তাঁদের পরিবার এই মৃত্যুগুলোকে—যার মধ্যে কথিত আত্মহত্যা বা হার্ট অ্যাটাক রয়েছে—নির্বাচনী কাজসংক্রান্ত মানসিক চাপের ফল বলে মনে করছেন। তবে বিবিসির পক্ষে মৃত্যুর কারণগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। বিবিসির পাঠানো বিস্তারিত প্রশ্নের তালিকার কোনো জবাব ভারতের নির্বাচন কমিশন দেয়নি।
গুজরাটে অরবিন্দভাই ভাধের নামে এক প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক নাকি গত মাসেই ‘বিএলও–এর কাজের অত্যাচারের কারণে’ আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁর পরিবার বিবিসিকে জানিয়েছে। মৃত্যুর আগে তাঁর লেখা একটি নোট বিবিসি দেখেছে। সেখানে ভাধের বলেছিলেন, বেশ কিছু দিন ধরেই তিনি ‘অবিরাম ক্লান্তি ও মানসিক চাপে’ ভুগছিলেন।
অন্য এক ঘটনায় গুজরাটের এক স্কুলের প্রধান রমেশভাই পারমার এসআইআর-এর কাজের চাপ নেওয়ার পর রাতে ঘুমন্ত অবস্থাতেই মারা যান বলে তাঁর পরিবার অভিযোগ করেছে। পারমারের মেয়ে শিল্পাবেন বলেন, তাঁর বাবা প্রায়ই অনেক লম্বা সময় ধরে বা রাত অবধি কাজ করতেন। যেদিন তিনি মারা যান, সেদিনও তিনি এসআইআর-এর কাজে অনেক বার বাইরে গিয়েছিলেন এবং না খেয়েই শুতে গিয়েছিলেন।
এতগুলো মৃত্যুর পর এখন পোল কর্মীদের কাজের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিরোধী দলের নেতারা ইসির ও সরকারের সমালোচনা করেছেন, এত দ্রুত এসআইআর কাজ শেষ করতে চাওয়ার জন্য। (এর আগে ২০০২-২০০৩ সালে এসআইআর-এর কাজ ছয় মাস ধরে করা হয়েছিল।)
আদালতে পেশ করা একটি হলফনামার সূত্রে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা গেছে, এসআইআর-এর কাজের সঙ্গে বিএলওদের মৃত্যুর যোগ থাকার বিরোধীদের দাবি নির্বাচন কমিশন অস্বীকার করেছে। তারা এই সব দাবিকে ‘মিথ্যা, অত্যুক্তিপূর্ণ ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে অভিহিত করেছে। গত সপ্তাহে ইসি জানিয়েছে, এসআইআর-এর সময়সীমা ৪ ডিসেম্বর থেকে বাড়িয়ে ১১ ডিসেম্বর করা হবে। তবে এর কারণ তারা জানায়নি।
কিন্তু উত্তর প্রদেশের নয়ডায় একটি আবাসিক কমপ্লেক্সে এসআইআর-এর নেতৃত্ব দেওয়া এক স্কুলশিক্ষিকা মনীষা কুমারী (ছদ্মনাম) বলছেন, এই বাড়তি সময়ের মধ্যেও তিনি কাজ শেষ করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। গত এক মাস ধরে কুমারী ভোর পাঁচটায় উঠে বাড়ির কাজ সারেন ও ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করেন। তারপর সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা-ছয়টা অবধি এসআইআর-এর কাজ করেন।
তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘যেটুকু অল্প বিরতি পাই, সেটা খরচ হয় সেই সব লোকদের খুঁজে বের করার জন্য, যাঁরা প্রথমবার যখন গিয়েছিলাম, তখন বাড়িতে ছিলেন না।’ সন্ধ্যায়ও তাঁর নিস্তার নেই। বাড়ি ফিরে ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা করার পর তিনি এসআইআর অ্যাপে লগইন করে যাচাই করা ফরমগুলো আপলোড করেন। কিন্তু অ্যাপটি প্রায়ই ‘ক্র্যাশ’ করে, তাই কাজ শেষ করতে তাঁকে আবার মাঝরাতের পর চেষ্টা করতে হয়। তিনি বলেন, ‘৪ নভেম্বর থেকে আজ অবধি আমার একটিও ছুটি নেই।’ তিনি আরও জানান, ক্লাসে তাঁর অনুপস্থিতির কারণে ছাত্রছাত্রীদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে।
ভারতের বহু সরকারি স্কুলে কর্মীর অভাব রয়েছে। শিক্ষকেরা বলছেন, এই ধরনের কাজের জন্য তাঁদের ক্লাস থেকে তুলে নিলে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হয়। কিছু বিএলও বিবিসিকে জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যের ওপর এর খারাপ প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এই কঠিন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ তাঁরা আইনি পদক্ষেপের ভয় পান।
সম্প্রতি উত্তর প্রদেশের কর্মকর্তারা এসআইআর-এর কাজে অবহেলার অভিযোগে পোল কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আর অন্য রাজ্যগুলোতেও কাজ করতে না চাইলে জেল বা চাকরি হারানোর হুমকির খবর পাওয়া গেছে। উত্তর প্রদেশের হিসাবরক্ষক সুধীর কুমার কোরি নাকি তাঁর বিয়ের জন্য এক দিনের ছুটি নেওয়ায় তাঁর ঊর্ধ্বতন তাঁকে বকাবকি করেছিলেন। এরপরই তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে তাঁর পরিবার বিবিসি হিন্দিকে জানিয়েছে।
গাজিয়াবাদের এক পোল কর্মী সুনীল সিং (ছদ্মনাম) বলেছেন, গত কয়েক দিনে তাঁর ‘প্লেটলেট সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে’ কিন্তু এসআইআর-এর কাজের জন্য তাঁকে ছুটি নিতে দেওয়া হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘আমাকে ডাক্তার বিশ্রাম নিতে বলেছেন, কিন্তু এই কর্মকর্তারা কানেও নিচ্ছেন না। ছুটি পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো হাসপাতালে ভর্তি হওয়া।’ তিনি আরও জানান, তিনি রাজ্যের বিদ্যুৎ বিভাগের তাঁর চাকরিটি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন।
বিএলওদের তাঁদের কাজের চাপ নিয়ে আবেদন জানানোর কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি নেই। কিন্তু তাঁরা বিক্ষোভ করেছেন এবং সময়সীমা বাড়ানোর ও ভালো কাজের পরিবেশের জন্য ইসি ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে চিঠিও লিখেছেন। কিছু রাজ্য এই কাজের জন্য ছাত্র স্বেচ্ছাসেবকদের কাজে লাগাচ্ছে, আবার উত্তর প্রদেশের কিছু জেলায় সেরা কাজ করা বিএলওদের নগদ অর্থ, উপহার ও অন্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে যে, বিএলওদের দীর্ঘ কাজের সময় কমাতে এসআইআর কাজের জন্য যেন অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করা হয়। এখন ইসি বিএলওদের পারিশ্রমিক ছয় হাজার রুপি থেকে বাড়িয়ে বারো হাজার রুপি করেছে এবং সুপারভাইজারদের পারিশ্রমিক বারো হাজার রুপি থেকে আঠারো হাজার রুপি করেছে। এর পাশাপাশি বিএলওদের জন্য ছয় হাজার রুপির এসআইআর উৎসাহ-ভাতা যোগ করেছে। কিন্তু অনেক বিএলও বিবিসিকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা এখনো কোনো টাকাই পাননি, আর তাঁদের প্রাপ্য কত টাকা, তা-ও অনেকে জানেন না।
এর আগে এক ক্ষেত্রে, ইসি পশ্চিমবঙ্গে বিএলওদের টাকা দিতে দেরি হওয়ার জন্য রাজ্যকে দায়ী করেছিল, আবার রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তহবিল আটকে রাখার অভিযোগ তুলেছিল। অনেক বিএলও বিবিসিকে বলেন, তাঁরা এসআইআর-এর কাজের জন্য নিজেদের টাকাপয়সা ও মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নয়ডার এক পোল কর্মী বলেন, ‘টাকা পাই কি না, দেখি। আশা খুবই কম।’