ইউক্রেন-রাশিয়া প্রথম আলোচনা কোনো ফল ছাড়াই শেষ হয়েছে। যুদ্ধ চলছে। গোটা বিশ্ব ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে সে যুদ্ধের দিকে তাকিয়ে। মুদ্রাবাজার থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে এরই মধ্যে পড়েছে ভয়াবহ প্রভাব, যা সামনের দিনগুলোতে আরও বাজে আকার নিতে পারে বলে জোর আশঙ্কা রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, গোলা ফুটছে, বারুদের গন্ধ এখন বাস্তব এবং মানুষ মরছে। সামরিক হোক, বেসামরিক হোক, ইউক্রেনীয় হোক কিংবা রুশ, মানুষই মরছে। এই যুদ্ধকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দম্ভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন অনেকে, অনেকে আবার নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রত্যাশায় শিহরিত। যুক্তরাষ্ট্র ও গোটা ইউরোপ এর সঙ্গে জড়িয়ে গেলে এ যুদ্ধের ফল কী হবে, কেউ জানে না। কিন্তু ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি বলছেন, যুদ্ধে পুতিনের পরাজয় এরই মধ্যে হয়ে গেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত হারারির এই লেখায় উঠে এসেছে যুদ্ধের বাস্তবতা যেমন, তেমনি এসেছে গোটা বিশ্বের ভবিষ্যতের ওপর এর প্রভাবের বিষয়টিও। আজকের পত্রিকার পাঠকদের জন্য থাকল তাঁর পুরো লেখাটির অনুবাদ—
ইউক্রেন যুদ্ধে এরই মধ্যে হেরে গেছেন পুতিন
ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি
এখনো হয়তো ইউক্রেন দখল করতে পারবে রুশরা। কিন্তু গত কয়েক দিনে ইউক্রেনীয়রা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা এটি ধরে রাখতে পারবে না।
যুদ্ধ শুরুর এক সপ্তাহেরও কম সময় গেলেও যত সময় যাচ্ছে, ততই মনে হচ্ছে, ভ্লাদিমির পুতিন ক্রমেই এক ঐতিহাসিক পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সবগুলো লড়াইয়ে জিতলেও তিনি এ যুদ্ধে হেরে যাবেন। পুতিনের রুশ সাম্রাজ্য পুনঃপত্তনের স্বপ্ন সব সময়ই একটি মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে—ইউক্রেন সত্যিকারের কোনো জাতি নয়, ইউক্রেনীয়রা সত্যিকারের কোনো মানুষ নয়, আর কিয়েভ, খারকিভ, লভিভের বাসিন্দাদের জন্ম মস্কোর শাসনে থাকার জন্যই। এটি একটি ডাহা মিথ্যা। ইউক্রেন একটি জাতি, যার রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। আর যখন মস্কো একটা অজ গ্রামও নয়, তখনই কিয়েভ মহানগর। কিন্তু রুশরা এই মিথ্যা তাদের এতবার বলেছে যে, ইউক্রেনীয়রাও এখন এটি বিশ্বাস করে।
ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনার সময় পুতিন হয়তো অনেক জানা বিষয়কে বিবেচনা করতে পারতেন। তিনি জানতেন, সামরিক দিক থেকে রাশিয়ার কাছে ইউক্রেন অতি ক্ষুদ্র। তিনি জানতেন, ইউক্রেনকে সাহায্য করতে সেনা পাঠাবে না ন্যাটো। তিনি জানতেন, রাশিয়ার জ্বালানি তেল ও গ্যাসের ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতা জার্মানির মতো দেশগুলোকে রাশিয়ার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপে দোনোমনায় ফেলবে। এই সব জানা সত্ত্বেও তাঁর পরিকল্পনা ছিল ইউক্রেনে দ্রুততম সময়ে জোরালো হামলা চালানো, এর সরকারকে উৎখাত করা, কিয়েভে একটি পুতুল সরকার বসানো এবং এর মাধ্যমে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার জের কাটিয়ে ওঠা।
কিন্তু এই পরিকল্পনার সঙ্গে জুড়ে ছিল আরেকটি বড় অজানা বিষয়ও। ইরাক থেকে মার্কিনরা যেমন, তেমনি আফগানিস্তান থেকে রাশিয়ার পাওয়া শিক্ষা থেকে এটা পরিষ্কার যে, কোনো দেশকে হয়তো দখল করা যায়, কিন্তু তা ধরে রাখা অনেক কঠিন। পুতিন জানতেন, ইউক্রেন দখলের শক্তি তাঁর আছে। কিন্তু ইউক্রেনের মানুষ কি মস্কোর পুতুল সরকারকে মেনে নেবে? পুতিন বাজি ধরেছেন যে, তারা (তাঁর সে সরকার) মেনে নেবে। যেহেতু যেকোনো শ্রোতাকেই পুতিন এই কথাই বারবার ব্যাখ্যা করেছেন যে, ইউক্রেন বাস্তব কোনো জাতি নয়, আর ইউক্রেনীয়রা নয় বাস্তবের জনতা। ২০১৪ সালে রুশ বাহিনী ক্রিমিয়ায় তেমন প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়নি। তাহলে ২০২২ সালে অন্য কিছু কেন হতে যাবে?
প্রতিটি রুশ ট্যাংক ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে এবং প্রতিটি রুশ সেনার মৃত্যুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ যুদ্ধের সাহস। আর প্রতিটি ইউক্রেনীয়র মৃত্যুর সঙ্গে বাড়বে রুশদের প্রতি তাদের ঘৃণার মাত্রা। আর কে না জানে ঘৃণাই সবচেয়ে কদর্য আবেগ। কিন্তু নিপীড়িত জাতির জন্য ঘৃণা এক গোপন রত্ন। হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থেকে এটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার জ্বালানি দেয়। রুশ সাম্রাজ্য পুনঃপত্তনের জন্য পুতিনকে তুলনামূলক রক্তপাতহীন জয় পেতে হবে, যাতে দখলটি তুলনামূলক ঘৃণাহীন হয়। ইউক্রেনীয়দের রক্ত ঝরানোর মধ্য দিয়ে পুতিন তাঁর স্বপ্নের বাস্তবে রূপ না পাওয়ার বিষয়টিই নিশ্চিত করছেন। রুশ সাম্রাজ্যের মৃত্যুর সনদে তখন আর মিখাইল গর্বাচেভ নন, লেখা থাকবে পুতিনের নাম। গর্বাচেভ যখন যান, তখন রুশ ও ইউক্রেনীয়দের মধ্যে ছিল পরস্পরের প্রতি সহদোরের অনুভূতি। আর পুতিন তাদের শত্রুতে পরিণত করেছেন। ইউক্রেনীয় জাতি এখন থেকে নিজেকে রাশিয়ার বিরোধী পক্ষ হিসেবেই যেন ভাবে, সে বিষয়টিও তিনি নিশ্চিত করেছেন।
জাতি মূলত গড়ে ওঠে গল্পের ভিতে। প্রতিটি দিন যাবে, আর নতুন নতুন গল্পের নির্মাণ হবে, যা এই অন্ধকার দিনগুলোতেই শুধু নয়, পরবর্তী দশকগুলোতেও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ইউক্রেনীয়রা বলে যাবে। রাজধানী ছেড়ে যেতে না চাওয়া প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গোলাবারুদ চেয়েছেন, কোনো ফ্লাইট নয়; স্নেক আইল্যান্ডের সৈনিকেরা রুশ যুদ্ধজাহাজের উদ্দেশে বলেছে, ‘দূরে গিয়ে মরো’; আর বেসামরিক লোকেরা পথের ওপর বসে থেকে রুশ ট্যাংককে থামাতে চেয়েছে। এ হলো সেই সব গল্প, যা থেকে একটি জাতি গড়ে ওঠে। দীর্ঘ যাত্রায় এই গল্পগুলোর মূল্য ট্যাংক বাহিনীর চেয়ে বেশি।
অন্য যে কারও মতো রুশ স্বৈরশাসকেরও এটি জানার কথা। তিনি সেই সময়ে বেড়ে ওঠা শিশু, যখন অবরুদ্ধ লেনিনগ্রাদে চালানো জার্মান নৃশংসতা ও রুশ বীরত্বের গল্পগুলো ঘুরে বেড়াত। তিনিই এখন একই ধরনের গল্পের উৎপাদন করছেন, তবে নিজেকে বসিয়ে হিটলারের আসনে।
আমরা সবাই তখন কিছু না কিছু করার সাহস পাব, হোক সেটা অনুদান, হোক শরণার্থীদের স্বাগত জানানো, কিংবা হোক অনলাইনে এ লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন জানানো। ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো বিশ্বের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবে। যদি অত্যাচার ও আগ্রাসনকে জয়ী হতে দেওয়া হয়, তবে তার জন্য আমাদের সবাইকেই ভুগতে হবে। শুধু পর্যবেক্ষক হয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। এখন উঠে দাঁড়ানোর সময়, নিজ অবস্থান প্রকাশের সময়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হচ্ছে। ধরন পাল্টে এটি বছরের বছর ধরে চলতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এরই মধ্যে হয়ে গেছে। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলি গোটা বিশ্বের কাছে এটা প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ইউক্রেনীয় জাতি খুবই বাস্তব এবং ইউক্রেনীয়রাও বাস্তব মানুষই এবং তারা নিশ্চিতভাবেই রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে বাস করতে চায় না। এখন মূল প্রশ্নটি হলো—ক্রেমলিনের চওড়া দেয়াল ভেদ করতে এই বার্তার কত সময় লাগবে?
লেখক: ইতিহাসবিদ ও লেখক