রাজধানীর অপরাধজগতে রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের দিন নিতান্ত মন্দ কাটছিল না। কিন্তু তিনি ফেঁসে যান পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশও ছাড়তে হয়। দুবাইয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন আরেক সাম্রাজ্য। এদিকে দেশে বিচারের আশায় দিন গুনছেন পুলিশ কর্মকর্তার মা।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, নিহত মামুনের পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দুজন বেঁচে আছেন। তিন সন্তান হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধা মা জায়েদা বেগম। রাজধানীর মধ্য বাসাবোর ১২৯ নম্বর বাড়িতে বড় ছেলে জাহাঙ্গীর আলম খানের সঙ্গে থাকেন তিনি। জায়েদা বেগম বলেন, ‘আমার নিরপরাধ ছেলেকে ডেকে নিয়ে খুন করা হলো। কেন, কারা এই হত্যা করেছে? এই হত্যার বিচার কি আমি দেখে যেতে পারব না?’
নিহত মামুনের খাটে ঘুমান মা জায়েদা বেগম। নিহত ছেলের কথা মনে করে কাঁদেন তিনি। তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মামুন ছিলেন সবার ছোট। মামুনসহ তিন ছেলে মারা গেছেন। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই জায়েদা বেগম মধ্য বয়সে স্বামী আজহার আলী খানকে হারিয়েছেন। বড় ছেলে জাহাঙ্গীর ও মেজ ছেলে আলম হোসেন খান রেলওয়েতে চাকরি পান পোষ্য কোটায়। দুজনই বেঁচে আছেন।
মধ্য বাসাবোতে গিয়ে দেখা গেছে, মামুনদের বাড়িটি অনেক পুরোনো। বাড়ির মালিক বেলাল হোসেন আমেরিকাপ্রবাসী। বাড়ির নিচতলার ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে থাকেন মামুনের স্কুলজীবনের বন্ধু মো. মাসুম। তিনি বলেন, ‘মামুন যেদিন বিকেলে বনানী যায়, সেদিন আমাকেও যাওয়ার জন্য বলেছিল। কোনো এক মডেলের জন্মদিন উদ্যাপন হবে, কিন্তু আমি যাইনি। এই ঘটনার পর তার লাশ উদ্ধার হয়।’ মামুন হত্যা মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়েছে চার বছর পর। গত ২১ মার্চ ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্য দেন বাদী জাহাঙ্গীর আলম খান।
মামুন ২০০৫ সালে সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পুলিশে যোগ দিয়েছিলেন। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশে (সিএমপি) তিনি চাকরি করেছেন। ২০১৫ সালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান। খুন হওয়ার আগপর্যন্ত তিনি পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত ছিলেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি নিয়মিত নাটক-টেলিফিল্মে অভিনয় করতেন।
যেভাবে খুনি চক্রের ফাঁদে
অভিনয় করতে গিয়ে একটি চক্রের সঙ্গে মামুনের সখ্য গড়ে উঠেছিল, যারা উঠতি বয়সী মডেলদের দিয়ে ফাঁদ পাতত। দুবাইয়ে আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম আরাভ খান ছিল এই চক্রের অন্যতম সদস্য। তারা রাজধানীতে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ, এমনকি খুন করত। মামুন হত্যা মামলায় অভিযোগপত্রে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, অভিনয় করতে গিয়ে মামুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় রহমত উল্লাহর। পরিচয় হয় মেহেরুন্নেছা স্বর্ণার সঙ্গেও। স্বর্ণা তাঁর বান্ধবীর জন্মদিনে বনানীর বাসায় রহমতকে দাওয়াত দেন। রহমত দাওয়াতে মামুনকে যেতে বলেন। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় মামুন বাসা থেকে বেরিয়ে রাত ৮টা ২০ মিনিটে বনানী ২ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়ির সামনে যান। সেখানে রহমতের সঙ্গে দেখা হয়।
প্রতিবেদন মতে, রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে স্বর্ণা ওই ভবনের সামনে আসেন। সঙ্গে ছিলেন কেয়া ও মীম। তাঁরা সবাই ২ /এ ফ্ল্যাটে যান। বিষয়টি আরাভ দূর থেকে দেখেন। ফ্ল্যাটে ঢুকে মামুন জন্মদিনের কোনো আয়োজন না দেখে স্বর্ণাকে প্রশ্ন করেন, ‘তোমাদের নাকি বার্থ ডে পার্টি, তার তো কিছু দেখছি না?’ অপর একটি কক্ষে ঘাপটি মেরে থাকা দিদার, আতিক, স্বপন, মিজান ও ছানোয়ার বেরিয়ে এসে মামুনকে গালাগাল করতে থাকেন। এরপর পাঁচ তরুণ মামুনকে এলোপাতাড়ি মারতে থকেন। দিদার, স্বপন ও রহমত উল্লাহ মামুনকে নগ্ন করে মেয়েদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি তোলার নির্দেশ দেন। তাঁরা নির্দয়ভাবে মারতে থাকলে মামুন অজ্ঞান হয়ে যান। রাতে সেখানে আরাভ ও তাঁর স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার কেয়া উপস্থিত হন।
ভোরে তরুণেরা নিশ্চিত হন মামুন মারা গেছেন। রহমত বলেন, লাশ গুম করতে হবে। স্বপন বিষয়টি আরাভকে জানান। ভোর সাড়ে ৬টার দিকে আরাভ দুটি বস্তা ও একটি সাদা কাপড় নিয়ে বনানী যান। পরে রহমতের গাড়িতে লাশ তুলে স্বপন, দিদারসহ আব্দুল্লাহপুরের দিকে যেতে থাকেন। রাত সাড়ে ৮টার দিকে লাশ বের করে বাঁশঝাড়ে নিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আরাভকে তাঁরা ফোনে বিষয়টি জানান।
আরও পড়ুুুন: