লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হলো এমন একটি সাধারণ ভাষা, যা ভিন্ন ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার জন্য ব্যবহার করেন। এ ভাষা ব্যবহারকারীদের সবার মাতৃভাষা ভিন্ন হয়ে থাকে। আরও সহজভাবে বললে, যদি একজন চায়নিজ, একজন বাংলাদেশি আর একজন ফরাসি মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন, তখন তাঁরা সবাই আলাদা ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু এমন পরিবেশে তাঁরা যে ভাষায় একে অন্যকে বুঝতে পারেন, সেটাই তাঁদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। এটি এমন একটি সাধারণ ভাষাকে বোঝায়, যা কোনো দেশের নিজস্ব ভাষা। যেটা অন্য ভাষাভাষী মানুষ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে শেখে এবং সে দেশে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।
লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা শব্দটি এসেছে মধ্যযুগের ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের একটি মিশ্র ভাষা থেকে। যেটি ছিল রোমান্স ভাষার ওপর ভিত্তি করে তৈরি একধরনের পিজিন। মানব ইতিহাসে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময় লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা গড়ে উঠেছে। এগুলো সৃষ্টি হয়েছে বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, কূটনৈতিক, প্রশাসনিক এবং বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী ও পণ্ডিতদের পরস্পরের জ্ঞান বিনিময়ের জন্য। অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে বহু মানুষের ব্যবহৃত ভাষা অনেক সময় আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে যেমন ইংরেজি একধরনের বিশ্বব্যাপী লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। চলুন, জেনে নেওয়া যাক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা কেন জানা দরকার:
যোগাযোগের জন্য
আন্তর্জাতিক ভাষা ও লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা জানলে পৃথিবীর যেকোনো দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলা অনেক সহজ হয়। মানুষের ভাষা ভিন্ন হলেও একটি সাধারণ ভাষা জানলে সবাই একে অন্যকে বুঝতে পারেন। ধরুন, একজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ফ্রান্সের একজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলছেন। যদি দুজনেই ইংরেজি জানেন, তাহলে তাঁদের যোগাযোগ খুব সহজ হয়। তাঁরা তাঁদের কাজ, পণ্য, দাম, সমস্যা—সবকিছু স্পষ্টভাবে বলতে পারেন। আবার একজন ছাত্র যদি বিদেশে পড়তে যায়, তাহলে ইংরেজির মতো একটি গ্লোবাল ল্যাংগুয়েজ জানলে তার ক্লাসে পড়া বুঝতে সুবিধা হয়।
ইংরেজি ভাষা ছাড়াও লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে ফরাসি ও উর্দু ভাষা ব্যবহৃত হয়। আফ্রিকার অনেক দেশে ফরাসি একটি আঞ্চলিক লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাকিস্তানে বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠীর মধ্যে উর্দু একটি জাতীয় লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা।
শিক্ষা ও জ্ঞানের দরজা খোলে
বিশ্বের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ বই, গবেষণাপত্র, ওয়েবসাইট, টিউটোরিয়াল এবং ভিডিও—সবই ইংরেজির মতো একটি আন্তর্জাতিক ভাষায় পাওয়া যায়। যাঁরা এই ভাষা জানেন, তাঁরা পৃথিবীর যেকোনো জায়গার জ্ঞান সহজে পেতে পারেন। যেমন: গণিত, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মেডিসিন—সব বিষয়ের উন্নত বইয়ের বেশির ভাগই ইংরেজিতে লেখা। বিদেশি বিভিন্ন অনলাইনে কোর্স করতে চাইলেও ইংরেজি জানা জরুরি। কারণ এখানেও ক্লাস, লেকচার, অ্যাসাইনমেন্ট সব ইংরেজিতে হয়ে থাকে। এমন পরিবেশে একটি লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা জানলে তাঁর জন্য জ্ঞান আহরণের দরজা খুলে যায়।
সংস্কৃতিগত সংযোগ তৈরি করে
একটি আন্তর্জাতিক ভাষায় আমরা শুধু কথাই বলি না; বরং অন্য দেশের মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং অনুভূতি সম্পর্কে বুঝতে পারি। অন্য দেশের গান, সিনেমা, নাটক, বই—সবকিছু সহজে বুঝতে পারি। এতে সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়ে, একে অন্যের প্রতি সম্মান বাড়ে। দুই দেশের মানুষের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি কমে আসে। কারণ তাঁরা যোগাযোগ করতে পারেন এবং অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন। একটি সাধারণ ভাষা মানুষকে আরও কাছে এনে দেয়, যা সংস্কৃতি থেকে সম্পর্ক—সবকিছুই মজবুত করে।
ভ্রমণ ও পর্যটনে সাহায্য করে
বিদেশে গেলে যেটা সবচেয়ে বেশি দরকার হয়, সেটা হলো কথা বলা। আন্তর্জাতিক ভাষা জানলে বিদেশে ভ্রমণ অনেক সহজ হয়। আপনি বিমানবন্দর, দোকান, রেস্টুরেন্ট, ট্রেন—সব জায়গায় লোকজনের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ করতে পারবেন। পথ হারালে রাস্তায় কাউকে প্রশ্ন করতে পারবেন। ট্যুর গাইডের কথা বুঝতে পারবেন। এতে আপনার মানচিত্র পড়া সহজ হবে।
বিশ্বায়নের যুগে প্রয়োজনীয় দক্ষতা
এখন পৃথিবী ছোট হয়ে গেছে। সবাই সবার সঙ্গে সংযুক্ত। তাই একে অন্যের ভাষা বোঝার জন্য লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা জানা জরুরি। পিজিন ভাষাগুলো তাই সাধারণত লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একইভাবে ক্রেওল ভাষা এবং কিছু ক্ষেত্রে মিশ্র ভাষাও ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। বিশ্বায়নের এ যুগে এমন একটি বিদেশি ভাষা নিজের আয়ত্তে থাকা উচিত, যে ভাষাকে যেকোনো পরিবেশে কাজে লাগানো সম্ভব হয়। লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কাকে বিশ্বায়নের এ যুগে গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।