চট্টগ্রাম: `কোন দোষে আমি ১৭ মাস জেল খাটলাম? আমার সব ধ্বংস হয়ে গেছে। বাড়িঘর সব বেচাকেনা হয়ে গেছে।' কথাগুলো হাসিনা বেগমের। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। তার আগে কারাগারের অন্ধকার খুপরিতে কাটাতে হয়েছে তাঁকে ১৭ মাস। বিনা দোষের এই কয়েদি জীবন অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে তাঁর কাছ থেকে।
হাসিনা বেগমের এই ১৭ মাসের কারাভোগের জন্য তাঁর দোষ যদি কিছু থেকে থাকে, তবে তা হলো মাদক মামলার এক আসামির সঙ্গে নামের একাংশের মিল। চট্টগ্রামে একটি মাদক মামলার আসামির সঙ্গে নামের একাংশের মিলের কারণে গ্রেপ্তারের পর তাঁর জীবন থেকে চলে গেছে ১৭টি মাস। পুলিশের গাফিলতি, আর মামলার দীর্ঘসূত্রিতা—দুই মিলে বলা যায় সর্বস্বান্ত হয়েছেন হাসিনা ও তাঁর পরিবার।
মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক শরীফুল আলম ভুঁঞার আদালত হাসিনা বেগমের মুক্তির আদেশ দেন। টেকনাফ থানার পুলিশের প্রতিবেদন ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের রেজিস্ট্রারের যাচাই করে দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সাজা ভোগকারী নারী প্রকৃত আসামি নন বলে নিশ্চিত হওয়ার পর নিরপরাধ হাসিনাকে মুক্তির আদেশ দেন আদালত।
মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় কারামুক্তির পর সাংবাদিকদের হাসিনা বলেন, `আমার অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু আমার ছেলেমেয়েদের কী হবে? আমি ১৭ মাস কেন জেল খেটেছি? বিনা দোষে কেন আমি জেলখানায় ছিলাম? এই দিনগুলো সরকার কখনো আমাকে ফেরত দিতে পারবে না।'
২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কর্ণফুলী থানার মইজ্জারটেকে ২ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন হাসিনা আক্তার। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে কারাগারে যান। তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা (মামলা নম্বর ৫৭/১৭) এবং পরে দায়রা মামলা ৩৬৩৭/১২ দায়ের হয়। পরে হাইকোর্ট থেকে জামিনে গিয়ে পলাতক হন হাসিনা আক্তার। ২০১৯ সালের ১ জুলাই পলাতক আসামির অনুপস্থিতিতে চট্টগ্রাম অতিরিক্ত মহানগর পঞ্চম আদালতের বিচারক জান্নাতুল ফেরদাউস চৌধুরী এ মামলার রায়ে ছয় বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন। পরে টেকনাফ থানা পুলিশ ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর টেকনাফের চৌধুরী পাড়া থেকে গ্রেপ্তার করে হাসিনা বেগমকে। নামের প্রথমাংশের মিল থাকাই তাঁর কাল হয়েছিল। এর পর থেকে টানা ১৭ মাস জেল খেটে গতকাল মঙ্গলবার মুক্ত হন হাসিনা বেগম।
বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আদালত টেকনাফ থানাকে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেন। সাজাপ্রাপ্ত আসামির নামের প্রথম অংশ ও তাঁর স্বামীর নামের সঙ্গে মিল রয়েছে হাসিনা বেগমের। যদিও তাঁদের বাবা-মায়ের নাম এক নয়। কারাগারে থাকা হাসিনা বেগমের বাড়ি কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানার চৌধুরীপাড়ায়। তিনি হামিদ হোসেনের স্ত্রী। সাজাপ্রাপ্ত আসামি হাসিনা আক্তারও একই এলাকার ইসমাইল হাজি বাড়ির হামিদ হোসেনের স্ত্রী। আর এই মিলের কারণেই ১৭ মাস ভুগতে হয়েছে হাসিনা বেগমকে।
নিজের ভোগান্তি নিয়ে হাসিনা বলেন, `আমি কর্ণফুলী থানা দেখি নাই। তারা বলেছে, এটা নাকি ১৭ সালের মামলা। তখন আমি কিচ্ছু বলতে পারি নাই। ওদেরকে (পুলিশ) বলছিলাম, এটা আমার মামলা না। তাঁরা বলেছে, ``এটা কক্সবাজারের মামলা না। চট্টগ্রামের মামলা, আমাদের কিছু করার নেই।'' ওইখানে (কক্সবাজার) ১০ দিন রেখেছিল আমাকে। যখন এইখানে চালান দেয় এখানকার অফিসেও (চট্টগ্রাম কারাগারে) বলছিলাম।'
কিন্তু হাসিনা বেগমের কোনো কথাই কেউ শোনেনি। বিষয়টি আমলে নিয়ে করেনি কোনো পুনঃতদন্ত। হাসিনার আইনজীবী গোলাম মাওলা আজকের পত্রিকাকে বলেন, `হাসিনা বেগম আগে অনেক উকিল ধরেছিলেন। আমি যতটুকু জানি, এই মামলায় পড়ে তাঁকে বাড়িঘরও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। পরে আমি নিজের টাকায় পিটিশন জমা দিই।'
আদালতে জানানোর পর পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ অনেকদিন থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দিচ্ছিল না। প্রায় ছয়-সাত মাস পর্যন্ত দেয়নি। এর পর আমরা একটা আবেদন করি যে, একটা স্পেসিফিক ডেট দেওয়া হোক। রিপোর্ট এল। সেই প্রতিবেদনে লেখা, হাসিনা বেগমের বয়স ৪০-৪২ বছর। আর যিনি আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, সেই নারীর বয়স ২৭ বছর।
আইনজীবী গোলাম মাওলা আরও বলেন, `তাহলে এই দুজন কীভাবে এক হয়! দুজনের বাড়িও ভিন্ন। পুলিশের গাফিলতির কারণে হাসিনা বেগম দীর্ঘ দেড় বছর কারাগারে ছিলেন। এই আদালতে এবং প্রয়োজনে উচ্চ আদালতে এ বিষয়ে আবেদন করা হবে, যাতে তিনি প্রতিকার পান।'