ভারতীয় রুপি ডলারের বিপরীতে আজ বুধবার ৯০–এর ঘর পার করেছে। একসময় যা বহুদূর বলে মনে হতো, চার দশকের দীর্ঘ সময়ের পতনের ইতিহাস ধরে তা এখন বাস্তবতা। দুর্বল পুঁজি প্রবাহ, আমদানিকারকদের লাগাতার চাহিদা এবং মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় থাকা কোম্পানিগুলোর নতুন করে হেজিংয়ের চাপের ফলেই রুপির এই পতন।
ডলারের রুপি এদিন ৮৯ দশমিক ৯০ এর কাছাকাছি দরে লেনদেন শুরু করে এবং আন্তঃব্যাংক ব্যবস্থায় সামান্য সময়ের জন্য ৯০–এর ঘর স্পর্শ করে। এই পতনের কারণে রুপি চলতি বছরে এশিয়ার সবচেয়ে দুর্বল মুদ্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে আট মাসের নিম্নমুখী প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
রুপির এই পতন-যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। সে সময়ই প্রথমবারের মতো রুপি ডলারের বিপরীতে ১০–এর ঘর পার করে। তখন ভারতের অর্থনীতি ছিল বদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ছিল চড়া এবং বিদেশি বিনিয়োগ ছিল নগণ্য। তবে বড় এবং আসল ধাক্কাটি আসে ১৯৯১ সালের এপ্রিলে। সে সময় ঐতিহাসিক ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টস’ সংকটের সময় ডলারের বিপরীতে রুপির মূল্য ২০ পার হয়ে যায়। সে যাত্রায় টিকে থাকতে ভারতকে স্বর্ণের সঞ্চয় বন্ধক রাখতে হয়েছিল এবং এর পরেই ঘটে যাওয়া তীব্র অবমূল্যায়নের ফলে দুই বছরের মধ্যে ডলারের বিপরীতে রুপি মূল্য ৩০–এর ঘরে নেমে আসে।
ডিএসপি মিউচুয়াল ফান্ডের সাহিল কাপুরের মতে, ২০ থেকে ৩০ রুপিতে নামার এই পরিবর্তনই রুপির দ্রুততম অবমূল্যায়নের সময়কাল, যার যৌগিক বার্ষিক হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে রুপি সামান্য স্থিতিশীল হলেও, ১৯৯৮ সালে এশীয় আর্থিক সংকট ও পোখরান পারমাণবিক পরীক্ষার পর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মুখে এটি ৪০–এর ঘর পার হয়। ২০০০ এর দশকের শুরুতে, বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতের তেজিভাব ও ভারতের পরিষেবা খাতে নিয়মিত অর্থ প্রবাহের কারণে রুপির দাম ৪৪ থেকে ৪৯–এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে।
পরবর্তী বড় পরিবর্তন আসে ২০০৮ সালের অক্টোবরে। সে সময় বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের মধ্যে ডলারের বিপরীতে রুপির দর ৫০ অতিক্রম করে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা উদীয়মান বাজার থেকে সম্পদ বিক্রি করতে শুরু করে, পণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়ে যায় এবং ঘরোয়া প্রবৃদ্ধি দারুণভাবে মন্থর হয়ে পড়ে।
এর পাঁচ বছর পর, ২০১৩ সালের জুনে ডলারের বিপরীতে রুপির ৬০–এর কাটা স্পর্শ করে। তখন নানা সমস্যার কারণে দেশীয় আস্থায় চরম সংকট দেখা দেয়। সে বছর রুপি ছিল এশিয়ার সবচেয়ে বাজে পারফর্ম করা মুদ্রাগুলোর একটি।
২০১৮ সালে তেলের দাম বৃদ্ধি, লাগাতার চলতি হিসাবের ঘাটতি এবং মার্কিন ডলারের শক্তিশালী হওয়ার কারণে রুপির মূল্য ৭০–এর দিকে ধাবিত হয়। চার বছর পর, ২০২২ সালের জুলাইয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় এই মুদ্রা ৮০–এর ঘরও পার করে ফেলে। সে সময় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং ফেডারেল রিজার্ভের আগ্রাসী হারে সুদ বাড়ানোর ফলে বিশ্বজুড়ে সবাই ডলারের দিকে ঝুঁকেছিল। আর এখন, গাঠনিক ও স্বল্প-মেয়াদি উভয় ধরনের চাপের মিশ্রণে রুপির দর ৯০ ছুঁয়েছে। বছরের শুরু থেকে এটি প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে—যা এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত পতনের মধ্যে অন্যতম।
চলতি বছর রুপির দর অবমূল্যায়নের কারণ কী
সবচেয়ে বড় আঘাতটি এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ শুল্ক থেকে, যা ভারতের রপ্তানিতে আঘাত হেনেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছে। এ বছর বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় ইক্যুইটি থেকে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে দিয়েছে। ভারত মোট বিনিয়োগে বড় অঙ্কের অর্থ আকর্ষণ করলেও, আইপিও ও বেসরকারি ইক্যুইটি বিনিয়োগকারীদের বড় আকারের প্রস্থানের ফলে নিট প্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে গেছে।
সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও দুর্বল হয়েছে। টানা দুই মাস ধরে নিট এফডিআই ঋণাত্মক। কারণ ভারতীয় কোম্পানিগুলো বিদেশে বেশি করে অধিগ্রহণ করছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের পুরোনো বিনিয়োগের অর্থ নিজ দেশে ফিরিয়ে নিচ্ছে। রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই)নভেম্বরের বুলেটিনে এই প্রবণতার ওপর জোর দিয়েছে। সেখানে বাইরের এফডিআই বৃদ্ধি এবং পুনরায় বিনিয়োগ করা আয়ের হ্রাস তুলে ধরা হয়েছে।
এদিকে, অক্টোবরে পণ্য বাণিজ্যের ঘাটতি সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। এটি প্রধানত সোনার আমদানিতে উল্লম্ফন এবং মার্কিন আমদানিকারকদের কাছে রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণে ঘটেছে। আরও অবমূল্যায়নের আশঙ্কায় আমদানিকারকরা দ্রুত তাদের হেজিং (মূল্য সুরক্ষার কৌশল) বাড়িয়েছে, আর রপ্তানিকারকরা ভালো দরের আশায় ডলার বিক্রি করা থেকে বিরত আছে। এই ভারসাম্যহীনতার কারণে পতনের প্রতিটি ধাপে রুপি আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর ভাঙার পরই—মঙ্গলবার ৮৮ দশমিক ৮০ ও বুধবার ৯০ পার করার পরই—নতুন করে ডলার কেনার ঢেউ উঠেছে।
আরবিআই (রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া) স্পট ও ফরওয়ার্ড উভয় বাজারেই ডলার বিক্রি করে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাহিদার মাত্রা এতটাই যে তাদের রিজার্ভ কমিয়ে আনতে এবং বড় আকারের ফরওয়ার্ড পজিশন তৈরি করতে বাধ্য হতে হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি চাপ কমাতে বাজারে ভবিষ্যতের ডলার সরবরাহের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চেষ্টার কারণে ফরওয়ার্ড বুকে ডলারের শর্ট পজিশন প্রায় ৬৩ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে, যা পাঁচ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, আরবিআই ধীরে ধীরে রুপিকে সামঞ্জস্যে ফিরে আসার সুযোগ দিচ্ছে। এইচএসবিসির অর্থনীতিবিদেরা এই মুদ্রাকে অর্থনীতির জন্য একটি ‘শক অ্যাবজর্ভার’ বা ধাক্কা সামলানোর যন্ত্র হিসেবে হিসেবে বর্ণনা করেছেন, বিশেষ করে উচ্চ শুল্কের সময়ে। একটি ধীর, নিয়ন্ত্রিত অবমূল্যায়ন ভারতের বাহ্যিক ভারসাম্যহীনতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে এবং বাণিজ্যের ক্ষেত্রে হঠাৎ বড় ধরনের বিকৃতি রোধ করে।
রুপি ৯০-এর ঘরে স্থিতিশীল হওয়ায় বাজার এখন সতর্ক অবস্থানে আছে। আমদানিকারকদের ডলারের চাহিদা জোরালো, জল্পনামূলক অবস্থান বেড়েছে এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সতর্ক। কেভিন হ্যাসেট পরবর্তী ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান হতে পারেন এমন প্রত্যাশার কারণে মার্কিন ডলার সামান্য দুর্বল হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। তবে ঘরোয়া কারণগুলো—দুর্বল প্রবাহ, হেজিংয়ের বিকৃতি এবং রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতি—এখনো যেকোনো বাইরের সমর্থনকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।